পি.আর.প্ল্যাসিড

বড়দিন সময়ের দিক দিয়ে মোটেও বড় দিন নয়। তাৎপর্যের দিক দিয়ে সারা পৃথিবীর খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাস বা গুরুত্বের দিক দিয়ে ২৫ শে ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দিনটিকে কে কিভাবে বলেন জানি না। তবে এটি সত্য যে ২৫শে ডিসেম্বরের এই দিনটি যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন নয়, যীশু খ্রীষ্টের জন্মোৎসব হচ্ছে এই বড়দিন। পৃথিবীতে অনেক ধর্ম আছে তাদের একেক ধর্ম স্রষ্টার জন্ম এবং কর্ম ভিন্ন। তাই তারা তাদের জন্মোৎসবও পালন করে ভিন্নভাবে।

আমরা যেই ক্যালেন্ডার দেখে কাজ করি প্রতিনিয়ত সেটি খ্রীষ্টের জন্মের সাথে মিল রেখে করা হয়েছে বলেই এই ক্যালেন্ডারকে বলা হয় খ্রীষ্টীয় ক্যালেন্ডার। আজ থেকে ২০১৫ বছর আগ থেকে এর হিসাব করা হলেও বাস্তবে ২০১৫ বছর আগে কোন দিন যীশু খ্রীষ্টের জন্ম হয়েছে সেই ইতিহাস কিন্তু কোথাও নেই। যে জন্য রোমান ক্যথলিক যারা, তারা এবং তাদের কাছাকাছি কিছু ধর্ম বিশ্বাসী গ্রুপ এই দিনটিকে ধার্য্ করে ২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিন অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের জন্মোৎসব পালন করে। আবার অনেকে খ্রীষ্টান হয়েও তারা পালন করে জানুয়ারি মাসের শুরতে বা অন্য কোন সময়ে।

খ্রীষ্টান ধর্ম বিশ্বাসী যারা তাদের বিশ্বাস যীশু [যাকে ইসলাম ধর্মে বলা হয় ঈসা আ.] তার জন্ম হয়েছে মরিয়মের গর্ভে এবং এই জন্ম ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই জন্ম কোন স্বাভাবিক জন্ম ছিল না। কারো সাথে মিলন ছাড়াই যেহেতু মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন সুতরাং এটিকে স্বীকৃত অলৌকিক ঘটনা বলা হয়। এটাই সারা পৃথিবীর খ্রীষ্ট বিশ্বাসীদের বিশ্বাস।

ঈশ্বরের সৃষ্ট এই মানবজাতি যখন পৃথিবীতে বিভিন্ন পাপ আর অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন ঈশ্বর এই মানব জাতিকে পরিত্রাণ বা মুক্তির জন্য যীশুকে এই পৃথিবীতে মানুষরূপে পাঠান এবং ঈশ্বর তাকে তার প্রতিনিধি হিসাবে নয় তার পুত্র হিসাবেই এই পৃথিবীতে পাঠান।

মানব জাতির সাথে একাত্ম হয়ে মানুষের এই পৃথিবীতে পাপ কাজ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ হিসাবেই কাজ করে যাচ্ছিলেন এই পৃথিবীতে আগমনের পর থেকেই। তাই অনেকেই সেই সময় তাকে বিশ্বাস করতে পারেন নি। যে কারণে তাকে এবং তার বিভিন্ন অলৌকিক কাজকে সহজে মেনে নিতে না পেরে তার বিরোধিতাই করেছে অনেক ক্ষমতাধর রাজা বাদশাহ এবং সর্বশেষ তাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে অনেক অত্যাচার করার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে সেই ঈশ্বরের ইচ্ছায় যীশু তার অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে কবর থেকে সরাসরি স্বর্গে গমন করেন।

যীশুর জন্ম এবং মৃত্যু দুটো দিবসকেই খ্রীষ্ট ভক্তরা অতি গুরুত্বের সাথে পালন করে। যীশুকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল শান্তির বারতা দিয়ে। তিনি মানব জাতির সুখ ও শান্তির জন্যই কাজ করেছেন। তার মানে খ্রীষ্ট জন্মের শুরুতেই এই পৃথিবীর মানব জাতি ছিল এক ধরনের অশান্তি, অপকর্ম আর পাপ কাজের সাথে জড়িত। যীশুর জন্মের পর এই পৃথিবী থেকে কি সেই পাপ কাজ এবং অশান্তি দূর হয়েছে? হয়েছে কি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ? উত্তর যদি হয় ”না” তাহলে প্রায় শোয়া দুই হাজার বছর আগে যীশু খ্রীষ্টের জন্ম বা আগমনের স্বার্থকতা কোথায়?

পৃথিবীতে এখনো মানুষে মানুষে হচ্ছে মারামারি, কাটাকাটি রাহাজানি এবং আরো কত জঘণ্য পাপকাজ। এ থেকে মুক্তির উপায় কি? আদৌ কি আমরা পাবো সেই মুক্তির পথ? সারা পৃথিবীতে এখন চলছে শক্তির বাহাদুরী। চলছে বুদ্ধির অপব্যবহার আর এই জন্যই যুদ্ধাংদেহী ভাব নিয়ে শক্তিধর দেশগুলো কম শক্তিধর দেশ গুলোকে প্রদর্শন করছে নানা ভাব। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে মারামারি কাটাকাটি রাহাজানি এবং যত ধরনের পাপকাজ। চলছে ধর্মে ধর্মে অনভিপ্রেত সমস্যা। এসবের সমাধান করতে এখন আর যীশুর জন্ম হবে না। আমাদেরই মানুষদের করতে হবে এর সমাধান। তবে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ অনুযায়ী মানুষের বিশ্বাস শেষ বিচারের দিন তিনি আবার আসবেন বিচার করতে। এই বিচারের ভয়ে আর পরজগতে স্বর্গবাসী হবার আশা নিয়েই মানুষ করছে হয়তো ভাল বা পুণ্যের কিছু কাজ। আর আমরা এই জন্যই মনে করি যীশুখ্রীষ্টের দেখিয়ে যাওয়া পথে চললেই পাবো এসব থেকে পরিত্রাণ বা মুক্তি।

পৃথিবীতে প্রায় সব ধর্মকে কেন্দ্র করে দেখা যায় বছরের একটি সময় বেশ বড় বাণিজ্য গড়ে ওঠে। এই বড়দিনকে নিয়েও তাই হয়। পৃথিবীর বড় বড় দেশে নভেম্বর মাস এলেই দেখা যায় দোকানপাঠ বা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে সাজানো শুরু হয়ে যায়। এই সাজানোর মধ্যে ক্রিসমাস ট্রি, ঘণ্টা তূষারের উপস্থিতি থাকে। এসব আবার শুরু হবার একটি ইতিহাসও আছে। এই বড়দিন উদযাপন উপলক্ষে ক্রিস্টমাস কার্ড আদান প্রদানও করা হয়। আর এই বড়দিন উপলক্ষে শুভেচ্ছা দেবার জন্য কার্ড আদান প্রদান থেকে মানুষের জন্মদিনের কার্ড আদান প্রদান শুরু। যদিও বর্তমান ইন্টারনেট এর যুগে অনেক কিছুরই ব্যবহার কমে গেছে। তারপরেও বড়দিন যেখানে পালিত হয় সেখানে এই বড়দিনের ভাবমূর্তি ও তাৎপর্য্ ধরে রাখার বিষয়টিও বাদ যায় না।

বড়দিনের আগের দিনকে বলা হয় ক্রিস্টমাস ইভ। এই ইভেই হয় যত আনন্দ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে য়ীশুর জন্মের উপর লেখা গান দিয়ে কীর্তন গাওয়া, পিঠা পুলি তৈরী করে খাওয়া, বিভিন্ন ধরনের পানীয় খাওয়াও হয় এই বড়দিনের আগের সন্ধ্যায়। আবার গীর্জাগুলোতে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজনও করা হয়। এই বড়দিন উপলক্ষে ছেলেমেয়ে বা বড়রাও নতুন জামাকাপড়ও নিয়ে থাকে।

যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে কিছুটা পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে, যা কখনো প্রত্যাশিত না। এবছর আমি বিভিন্নজনের সাথে কথা বলেছি। কথা বলে একটা বিষয়ই মনে হল, দেশে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী যারা আছে তার একটা বড় অংশ অনিশ্চিত আতংকের মধ্যে আছে। বড়দিন উদযাপন গত কয়েক বছর আগে যেভাবে পালিত হতো সেসব বছরের সাথে তুলনা করলে আগামী বছরগুলোতে কতটা বিগত বছরের মত হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। ভয় ভীতি মানুষের মনে সর্বদাই বিরাজ করছে যেন। সরকারের এই বিষয়ে আরো বেশী সচেতনতা অবলম্বন করে পূর্ণ ভাবে ধর্ম পালনে সুযোগ করে দেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। তা না হলে মানুষ একসময় তাদের সাধারণ বিবেকবুদ্ধি হারাবে। হারাবে দেশে কোন কাজ করার ভরসাও। সম্প্রতি মিডিয়ায় আসা কিছু সংবাদই তার প্রমাণ।

আমি যেহেতু জাপানে থাকি সুতরাং জাপানের প্রেক্ষাপটের কথাই বলি। জাপানে যে কয়টা গীর্জা আছে সে কয়টি কিন্তু বলা চলে রবিবার দিন পুরো খালিই থাকে। ধর্মের প্রতি তারা বেশ উদাসীন। অন্যান্য দিনেও একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু বড়দিন এলে এই ২৫ শে ডিসেম্বর গীর্জায় ঢুকে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু পর্যন্ত আর থাকে না। একদিনের জন্য যেন সকলেই হয়ে যায় খ্রীষ্টান।

সেখানে ছেলেমেয়েদের বড়দিনের উপহার দেওয়া হয় প্রকাশ্যে, আবার গোপনেও। গোপনে যে উপহার দেওয়া হয় সেটির কথা বলা হয় খ্রীষ্টমাস ইভে শান্তাক্লজ এসে রাতের অন্ধকারে দিয়ে গেছে তাদের এই উপহার। কিন্তু বিষয়টি ছেলে মেয়েরা বিশ্বাস করলেও আসলে এক ধরনের মিথ্যাকে বিশ্বাস করানো হয় এই বিশেষ দিনে। যা আমার মনে হয় আনন্দ করার জন্য মিথ্যা এক বিশ্বাসকে লালন করারই সামিল। আগে জাপানে একে অপরকে উপহার দিত। কিন্তু সেই সংস্কৃতি ক্রমেই শেষ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। ২০১২ সনের এক জরিপে দেখা গেছে জাপানী মেয়েরা বেশী বড়দিনের উপহার কিনে। এবং এটি কিনে আর অন্য কাউকে এখন আর দেয় না। নিজেরা নিজেদের জন্যই বড়দিন উপলক্ষে কেনা কাটা করে এবং গড়ে দেখা যায় এর পরিমাণ জাপানীজ ইয়েনে ৪৬০০০ইয়েন।

বাংলাদেশে এই বড়দিন উদযাপন করার রেওয়াজ বিস্তার ঘটেছিল বেশ। এউপলক্ষে বিভিন্ন ভবন সাজানো এবং মিডিয়াতে অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতার একটা উদাহরণ রয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে মোটামুটি সবধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন রয়েছে অক্ষুণ্ন। তাই আমাদের এ বন্ধন আরো অটুট রাখতে যে কোনো ধরণের প্রচেষ্টা সরকার নেবে বলে বিশ্বাস করি।

পৃথিবীর সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। খ্রীষ্ট ধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা যদি সবাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে থাকি তাহলে এত বিভাজন কেন, কেন ভেদা-ভেদ হানাহানি। এই শুভদিনে একটা কামনা হোক সর্বোতভাবে আমাদের- সব ধর্মের বিশ্বাসীদের মাঝে থাকুক সহমর্মিতা ও সার্বিক শান্তি। আমেন।

লেখক : জাপান প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক

(দ্য রিপোর্ট/এপি/ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬)