আজীজুল হক

স্বপ্নে দেখলাম স্যারকে বেঁচে আছেন এখনো।
একদমই একা নাকি? বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।
বিছানায় লেপ্টে আছে শরীর, মস্তিষ্ক তবু এক ছটফটে
ইঁদুরের মতো।

আমাকে না দেখেই বললেন, ‘এসেছ?’
অনেক কথা বললেন সাথে সাথে। দু’দুটো নতুন ওষুধের
নাম বললেন। সেগুলো খাবার সময়ের কথা বললেন।
আমি একটা বড়সড় ম্যাচবক্স সাইজের ডায়ারিতে সেসব
টুকে নিলাম।

ঘরটা আধো আধো অন্ধকার। স্যারের শরীরটা দেখা যাচ্ছিল
হাঁড়-মাংস-শাদা। বিছানায় মিশে-থাকা। সটান।

আমি তখন পাশের ঘরে গেলাম।
বিছানার ওপরে, চেয়ারে আট-ন’জন রঙিন তরুণ।
কলেজ-পড়ুয়াদের মতো। তারাই বোধহয় স্যারের দেখাশোনা
করে। ছেলেগুলো সহজ, উজ্জ্বল, আনন্দময়।

শুধু একটা গ্রহকে দেখলাম অস্থির।
কক্ষচ্যুত সেই গ্রহ থেকে কেবলই বিপরীত মহাকর্ষ
ছিটকে বেরুচ্ছিল।

জানা গেল স্যার এখনো বকবক করেন বহুরাত অব্দি।
রাত সাড়ে চারটা অব্দি।

এই ফ্ল্যাটটা পুরোনো। আমি এখানে আগেও এসেছি।
কিন্তু এখন খুঁটিনাটি সবকিছুই লাগছে আলাদা আর নতুন।


গিলগামেশ

সেইসব আহত গিলগামেশের সাথে দেখা হলো
মরুভূমির ঈষৎ শুকিয়ে যাওয়া হ্রদে।

আমআঁটির ভেঁপু বাজে আর চর্যালোকের আলো আসে।
আমাদের পৃথিবীর ওপার থেকে শুধু রঙিন চকখড়িতে
আঁকা দৃশ্য দেখা যায়।

লাল উড়ুনি, নীল কামিজ হেঁটে যায় আশ্চর্য আলোর ওপর।

দানবের রাজ্য দেখি। সোনাদিঘির ওই পারে।
আকাশ ফুঁড়েছে আজ লজ্জানীল ইস্পাতের আলো।
আলোর ক্ষীণকায়া উড়ে যায় চিহ্ন না রেখে।

সেইসব আহত গিলগামেশ অতি সন্তর্পণে ভেসে যায়
শৈবালরাঙা জলে।


ঝরাপাতার গান

কয়েকটি ঝরাপাতা পড়ে আছে ঘাসের ওপর।
তারাই সবচে’ বর্ণবাদী। হাহাকারের মতো তারা সুন্দর।

বৃষ্টিধারা যখন তাদের বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছিল আর
বরফরঙা শ্বেতশেয়ালেরা নাচ করছিল কুয়াশায়,
তখনও রাজকন্যা ঘুমিয়েই ছিল।

কিছুই সে জানত না, বাইরে চলছিল নিঃশব্দ হলুদ
কার্নিভাল, অতি ধীরে, দামামার শব্দ ছাড়াই।
দৌড়

এখনো অনেক পথ বাকি। ঘোড়ারৌদ্রে দৌড়ে এসেছি আর
এখনো ধুকপুক করে খরগোশের মতো কেঁপে উঠছে বুক।
বনমোরগেরা মগ্ন আছে তাদের আনন্দবীর্য নিয়ে। ভুলভুলাইয়া
বাঁশি বাজছে অরণ্যের গভীরে। নিষ্ঠুর দেবতা তাঁর বিলম্বিত ফণায়
মিশে আছে। কোনো পথ নেই। শুধু আত্মহননের প্রতীক্ষায়
দাঁড়িয়ে থাকা। দূরে শাদা জাহাজের সংকেত। মালবিকা!

কী কী সৌরভ লুপ্ত হয়ে আছে? আমি শুধুই বনের গান গাই।
আমাদের পৃথিবীর সিংহভাগ জুড়েই শুধু বন। সেখানে বাঘ আছে।
আর আছে রেশমের মতো ঘন অন্ধকার। মানুষের বসবাস থেকে দূরে।
নির্জলা স্বপ্ন এবং প্রেতেদের পুরী। চলো, সেখানেও যাই।
বেঁচে ফের ফিরে আসা কত যে মধুর!


ধর্মতলা

কাকতাড়ুয়া মিলে যাচ্ছে উল্কির সঙ্গে, নৌকাগুলো মিলে
যাচ্ছে ঘূর্ণির সঙ্গে, দোতারা মিলে যাচ্ছে বাতাসের সঙ্গে।

থোকা থোকা জোনাকির সাথে তুড়ি দিয়ে বাঁশবন অকস্মাৎ
উধাও হয়ে গেল। সেইখানে হিমশীতল এক বাড়ি, পুনর্বার
রক্তকাণ্ডের জন্যে কেবলই নিরিবিলি অপেক্ষায় থাকে।
তাল তাল জ্যোৎস্না গড়িয়ে যায় মধ্যযামের নিশুতিতে।
জ্যোৎস্না আর ছাতিমের মিলিত সৌরভে সয়লাব অন্দর আর
আঙিনা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুড়ির ঘরবাড়ি আবার
আযানের ছদ্মবেশ পরে নেয়, নিমগ্নতার ভান করে নিস্পন্দ
তলিয়ে যায়।

কী কী অঞ্জলি এনেছিস?
বাসকপাতার ফুল, বনশটির তোড়া, ক্ষুদে ক্ষুদে আত্মাহুতি।

‘আমরাও একদিন...’ এই বলে ছেলে তার ক্ষীণ দুই বাহু মেলে
উড়ে গেল সবুজ ধানক্ষেতের উপর দিয়ে। সবুজ দোলনচাপার
ঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো সিরসির পতঙ্গ এক। আতসকাচের ভুল
বেয়ে উঠে এলো ঊর্ধ্বমুখী ডগায়।

নিরীক্ষণে নক্ষত্র উঁকি দেয়। দূরে শুকতারা। মায়াবি পথঘাট।
আমাদের ভেলায় আর কারো জায়গা হবে না, শুধু এক
সবুজসোনালি সাপ দোল খায়, রশ্মি ছড়ায়, রংধনু...।
একাকার নদী থেকে উঠে আসে বাতাসের কারসাজি, ভ্রম আর
মাছের ঝিলিক...