সড়ক কিংবা সমুদ্রপথে নয়, আকাশ পথেই সৌদি আরবে পাচার হচ্ছে নারী। কর্মী হিসেবে বিদেশে যেতে হলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন ফ্লাইটে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে নারীকর্মী। অবৈধভাবে নারীকর্মী পাঠানোতে ঢাকাসহ সারাদেশে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। অর্থলোভী এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে নারী পাচার করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর ইস্কাটনস্থ প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এই প্রতিবেদকের কথা হয় মো. মারফত আলী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন, মুখভর্তি দাঁড়ি। চেহারায় বলছে ষাটের ঘরে বয়স তার। হাতে একটি চিঠি, পাসপোর্টের ফটোকপি। আলাপচারিতায় জানা গেল তার স্ত্রী মোছা. রোকেয়া বেগম (পাসপোর্ট নং বিএল০০০৫৪০৯) প্রায় ৬ মাস আগে সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে গেছেন। সেখানে যাওয়ার পর থেকেই তাকে শারীরিক, মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। স্ত্রী তাকে ফোন করে এসব জানিয়েছেন। ঢাকায় দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে চলেন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মী (নারী-পুরুষ) বিদেশে যেতে হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু, রোকেয়া বেগমের পাসপোর্ট নম্বর সংশ্লিষ্ট বিভাগে যাচাই করে দেখা গেল তিনি বিএমইটির স্মার্টকার্ড বা ছাড়পত্র নিয়ে সৌদি আরবে যাননি। বিএমইটির স্মার্ট কার্ড ছাড়া বিমানবন্দর পার হওয়ার সুযোগ নেই রোকেয়ার। কিন্তু, তিনি সৌদিতে গেলেন তাহলে কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয়। কোন এজেন্সির মাধ্যমে রোকেয়া সৌদি আরবে গেছেন, কিছুই জানা নেই তার প্রতিবন্ধী স্বামীর।

তবে তার কাছ থেকে পাওয়া রোকেয়ার সৌদি আরবের ভিসাসহ পাসপোর্টের ফটোকপি ও বিমানের টিকেট বুকিংয়ের এক টুকরো কাগজই অনুসন্ধানে একমাত্র ভরসা। সেই সূত্র ধরেই এগিয়ে চলে অনুসন্ধান।

রোকেয়ার স্বামী মারফত জানান, তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুনটা গ্রামে। থাকেন রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের দিকে। ওই এলাকাতেই ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনাতিপাত করেন। রোকেয়া তার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। রোকেয়ার দুই মেয়ে ও এক ছেলেও রয়েছে। যাদের বয়স ৭-১০ বছর। রোকেয়া বৈধভাবে সৌদি আরবে যাননি, তাই ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কিছুই করার নেই। তাই উপস্থিত কয়েকজনের পরামর্শে বিএমইটির ডিজি বরাবর আবেদন দিলেন মারফত।

মারফত জানালেন, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার জামাল ও মালেক নামে দুই ব্যক্তির মাধ্যমে তার স্ত্রী রোকেয়া সৌদিতে গেছেন। কিন্তু তাদের বিস্তারিত পরিচয় এবং কোন এজেন্সির মাধ্যমে বা কীভাবে গেছেন তার কিছুই জানাতে পারেননি।

রোকেয়ার বিমানের টিকিটের সূত্র ধরে জানা গেল, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে টুইন ট্রাভেলস নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে রোকেয়া বেগম ও নুন্নাহার নামে দুইজনের বিমানের (বিজি০০৩৯কে) টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইট ৯ সেপ্টেম্বর। এ ব্যাপারে ওই ট্রাভেল এজেন্সির মালিক জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা তো শুধু টিকেট কেটে দেই, বিদেশে কর্মী পাঠানোর কাজ তো আমাদের না। মোশতাক আহমেদ নামের এক ব্যক্তি এই (রোকেয়া-নুন্নাহার) টিকিট কেটেছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যেই যাত্রীদের টিকিট কাটেন। তার কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করা হয় মোশতাকের সঙ্গে। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তিনি বলেন, গুলশানের মো. জামাল হোসেন তাকে ওই টিকিট কাটতে বলেছিলেন। জামাল ভাটারা এলাকায় থাকেন, বাড়ি চাঁদপুরে। তবে তিনি কি করেন তা জানাতে পারেননি মোশতাক।

জামালের সঙ্গে মোশতাকের কিসের সম্পর্ক জানতে চাইলে মোশতাক বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যেই তাকে টিকিট কেটে দেই, এই আর কি।’ জামালের রিক্রুটিং এজেন্সি আছে কিনা জানতে চাইলে মোশতাক বলেন, তা আমার জানা নেই। আমি ট্রাভেল এজেন্সির মার্কেটিংয়ের কাজ করি। বিদেশ যাত্রীদের টিকেট কেটে দেওয়াই আমার কাজ। জামাল সাহেব মাঝেমধ্যেই সৌদি, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে যাত্রী পাঠাতে আমাকে টিকিট কাটতে দেন। একজন অপরিচিত লোকের বিদেশে কর্মী পাঠানোর টিকেট কেন কেটে দেন, এমন প্রশ্নের জবাব নেই মোশতাকের মুখে। তার কাছ থেকেই জামালের মোবাইল নম্বর নিয়ে কয়েকবার কল দেওয়ার পর রিসিভ করেন।

জামালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তিনি কোনো এজেন্সির মাধ্যমে নয়, ভিসা প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিএমইটির ছাড়পত্র ছাড়াই সরাসরি বিদেশে লোক পাঠান। ছাড়পত্র ছাড়া কর্মী পাঠানোর নিয়ম নেই, তবে কীভাবে পাঠাচ্ছেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, অ্যাম্বাসি ভিসা দিচ্ছে, ওখানে গিয়ে আকামা হচ্ছে….। সমস্যা কিসের?

সৌদিতে গিয়ে রোকেয়ার নির্যাতনে শিকার প্রসঙ্গে জামাল নামের ওই ব্যক্তি জানান, ‘…ও..., নুন্নাহারের বাসা মনে হয় বিশ্বরোড। এক মাস আগেও টাকা পাঠাইছে। আর রোকেয়ার হাজব্যান্ড আছে না...তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তার বাচ্চা কাচ্চার প্রবলেম, তাকে (রোকেয়া) যেন এনে দেওয়া হয়, বলেছে। সেখানে নির্যাতনের কোনো ঘটনা নাই।’

তার অফিস কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো বলার দরকার নাই। ফোন দিয়েন। এই দেশ থেকে যিনি এসব লোক নিচ্ছেন তিনি সৌদি অ্যাম্বাসির অ্যাটাশে। মোহাম্মদ, শিপন মোতাবি…। হাজার হাজার লোক যাচ্ছে, সমস্যা কিসের? আর যে লোকগুলো গেছে তারা কি টাকা দিছে আমাদের? বরং আমরাই দিছি। পাসপোর্টটাও বানিয়ে দিয়েছি।

এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জামাল নামের ওই ব্যক্তি। প্রশ্ন করেন, যে আপনাকে এসব বলেছে, কার মাধ্যমে এসেছে, দালাল কে? খুঁজতে বলেন তাকে। বস আমারে দিছে…। গত ৩০ জানুয়ারি ফোনে এসব কথা হয় জামালের সঙ্গে।

জামালের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই ফোন দেন রোকেয়ার স্বামী মারফত আলী। ১৯ জানুয়ারি প্রথম দিন এবং এর পরের কয়েকদিন যিনি তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আকুতি মিনতি জানিয়েছিলেন সেই তিনিই এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্যার দয়া করে তাকে (জামাল) আর ফোন দিবেন না। ৫ তারিখের মধ্যে (ফেব্রুয়ারি) সে আমার বউরে আইন্যা দিবে কইছে। দেখি না স্যার সে কি করে...।’

৫ ফেব্রুয়ারির পর ১০ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি রোকেয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় মারফতকে। বিনিময়ে বিমানের টিকিট কাটার জন্য ২৫ হাজার টাকাও নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোকেয়াকে ফিরিয়ে আনা হয়নি।

মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) দুপুরে রোকেয়ার স্বামী মারফত আলীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ফোন ধরেই তিনি বলেন, স্যার, বউরে তো সে আইন্যা দিল না। আজ দিব কাল দিব বইল্যা তো বহু দিন যাচ্ছে। এখন তো বউয়ের খোঁজ নাই। তার নম্বরে ঢোকে না, সেও ফোন দেয় না অনেকদিন হলো।

তিনি বলেন, বউরে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিএমইটিতে আবেদন করা হয়েছে। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আবেদন করেছি। ছেলে মাইয়্যাদের নিয়া তো স্যার সমস্যায় আছি…..কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন তিনি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং রিক্রুটিং এজেন্সির সূত্রগুলো জানায়, সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠাতে পাসপোর্ট তৈরি ছাড়া কোনো টাকা লাগে না। ওই দেশের নিয়োগকর্তারাই বরং এদেশের সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে একজন গৃহকর্মীর জন্য ন্যূনতম ১২শ’ রিয়াল দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৌদির নিয়োগকর্তারা দুই হাজার রিয়াল পর্যন্তও দিয়ে থাকেন। বিএমইটির ছাড়পত্রসহ বৈধ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে থাকে। তাই এক শ্রেণির দালালচক্র সৌদি আরব থেকে ভিসা সংগ্রহ করে বিএমইটির ছাড়পত্র না নিয়ে বিমানবন্দর কন্ট্রাক্টে নারীকর্মীদের পাচার করছে। এসব নারী সেখানে গিয়ে যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালক টিপু সুলতান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আমাদের ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশে কর্মী যাওয়ার সুযোগ নেই। কীভাবে ছাড়পত্র ছাড়া বিমানবন্দর পার হচ্ছেন কর্মীরা, সেটা সেখানকার কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।

এ ব্যাপারে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের এডিশনাল এএসপি এলিজা শারমিন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভিজিট ভিসা বা ফ্যামিলি ভিসা হলে যেতে পারবেন। কিন্তু ওয়ার্কার ভিসা হলে বিএমইটির ছাড়পত্র ছাড়া যাওয়ার সুযোগ নেই। ভিসার ক্রাইটেরিয়া কি ছিল সেটা তো দেখতে হবে। স্পেসিফিক তথ্য থাকলে পাসপোর্ট নম্বরসহ লিখিতভাবে জানাল চেক করে বলতে পারবো আসলে কি ঘটেছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/এনআই/মার্চ ১৪, ২০১৭)