প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ছে আগামী মার্চ মাসে। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ৫টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে বিইআরসিতে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভর না করে সরকারকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেন তারা।

সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ জন্য বিতরণ সংস্থাগুলো বিইআরসিকে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বর্তমান দামের ওপর ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) ২০ শতাংশ, ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) প্রায় ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) নতুন করে আর প্রস্তাব দেয়নি। তারা গতবারের প্রস্তাবই কার্যকর করার আবেদন করেছে। গতবার ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল ওজোপাডিকো।

সে সময় পিডিবি ১২ শতাংশ, আরইবি ৯ শতাংশ, ওজোপাডিকো ৯ দশমিক ৫৯, ডেসকো ১১ দশমিক ৬৯ এবং ডিপিডিসি ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। এর বিপরীতে গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজধানীর কাকরাইলের আইডিইবি ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘সরকার ভবিষ্যতে এ খাতে ভর্তুকি দিতে চায় না।’

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আগামী মাসের (মার্চ) প্রথম সপ্তাহেই কমিশনে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। শুনানি অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হবে এবং মার্চ মাস থেকেই তা কার্যকর হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তরল জ্বালানিভিত্তিক কুইক রেন্টাল, রেন্টাল ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায় নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি মাসে গড়ে ৬০০ কোটি টাকা হিসাবে বছরে নিট লোকসান হচ্ছে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার পুরো দায়ই পিডিবির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। বাস্তবে যে অর্থ সরকার বিদ্যুৎ খাতের জন্য ছাড় করছে, তার পুরোটাই ঋণ। এতে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটির দায় বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে পিডিবির আর্থিক সক্ষমতা ভেঙে পড়ছে। এ ভর্তুকি কমাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু এতেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।


সূত্র জানিয়েছে, পিডিবির নিজস্ব উৎপাদন ব্যয় এখনও গড়ে তিন টাকার নিচে রয়েছে। কিন্তু তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৮ টাকা। নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় যোগ করেই পিডিবির গড় ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেছে।

বিইআরসি সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গড়ে ৬ টাকা। এ বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ম. তামিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত বছরই (২০১৩) সরকার বিদ্যুতের দাম ৯-১২ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও নির্বাচনের বছর হওয়ায় তারা সেখান থেকে ফিরে আসে। এখন নির্বাচন শেষ, দাম তো বৃদ্ধি করবেই।’ তার মতে, মূলত তেলভিত্তিক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ না হবে, ততদিন এ সমস্যা থাকবেই।

সমস্যা সমাধানে কোনো বিকল্প আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে। তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক (দেশি বা বিদেশ থেকে আমদানি) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তাহলেই উৎপাদন খরচ কমবে।’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন খরচ বাড়বে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’

নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুনানিতে অংশ নেব, দেখব তারা কোন পারপাসে দাম বৃদ্ধি করে। তাদের প্রস্তাবের অসামঞ্জস্য বিষয়গুলো দেখে এর বিরোধিতা করব।’ এ জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক শামসুল আলম।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, ‘ভর্তুকির টাকা পূরণ করার জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরাসরি ট্যাক্স হিসেবে জনগণের কাছ থেকে টাকা নেবে।’

রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরনো পাওয়ার স্টেশনগুলো সংস্কার অথবা প্রয়োজনে পুরনো স্টেশনে নতুন করে মেশিন বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।’

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুহু রুহুল্লাহ বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সরকার বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি হলেও তার সঙ্গে দাম বৃদ্ধির সম্পর্ক নেই। বর্তমানে যে দামে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে মোট ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ মার্চ বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরপর ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাইকারি পর্যায়ে ১১ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করা হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট পাইকারি পর্যায়ে কার্যকর হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের মাথায় ১ ডিসেম্বর খুচরা পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। ৯ মাসের মাথায় গত ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারিতে বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানি শেষে পিডিবির ১২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপরীতে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ওজোপাডিকোর ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশের বিপরীতে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ, ডেসকোর ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, ডিপিডিসির ১১ দশমিক ৩১ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছিল পিডিবির জন্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৮৬ পয়সা, ডিপিডিসি ৬ টাকা ৩৫ পয়সা, ডেসকো ৬ টাকা ৪৫ পয়সা, ওজোপাডিকো ৫ টাকা ৮২ পয়সা এবং আরইবির জন্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/এনআই/এজেড/ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪)