আগামী মার্চ মাস থেকেই গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের নতুন মূল্য নির্ধারণে আগামী ৪, ৫ ও ৬ মার্চ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সম্মেলন কক্ষে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। কমিশনে রবিবার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান।

তিনি বলেন, ‘৫টি বিতরণী সংস্থা ও কোম্পানি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিডেট (ওজোপাডিকো) বিদ্যুতের নতুন মূল্য নির্ধারণে গত বুধবার আবেদন করেছে। মূল্যায়ন কমিটি এটি পর্যালোচনা করবে এবং এর উপর ৪, ৫ ও ৬ মার্চ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। শুনানিতে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কেন করা হবে এ জন্য যৌক্তিকতা তুলে ধরবে। পাশাপাশি ভোক্তাদের পক্ষ থেকেও এর যৌক্তিকতা পর্যবেক্ষণ করবে। সব কিছু বিবেচনা করে আমরা বিদ্যুতের চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করব।’

পরিবর্তিত বিদ্যুতের মূল্য কী পরিমাণ বাড়তে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘দাম পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু কী পরিমাণ বাড়বে তা বলা যাচ্ছে না।’

বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, ৪ মার্চ সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। পিডিবির পক্ষ থেকে ১৫.৫০ শতাংশ এবং ওজোপাডিকোর পক্ষ থেকে ৮.৫৭ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে।

৫ মার্চ সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড(ডিপিডিসি) এবং বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ডিপিডিসির পক্ষ থেকে ২৩.৫০ শতাংশ এবং ডেসকোর পক্ষ থেকে ১৫.৯০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বো্র্ডের (বিআরইবি) আবেদনের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে ৬ মার্চ সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে বেলা ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। বিআরইবি’র পক্ষে ১২.৫৬ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছে বিইআরসির কাছে।

এ ব্যাপারে বিইআরসির সদস্য অধ্যাপক ড. সেলিম মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কমিশনে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। শুনানি শেষে নতুন মূল্য নির্ধারিত হবে এবং মার্চ মাস থেকেই তা কার্যকর হবে।’

শুনানির মধ্য দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম তিন মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের গত ৫ বছরে মোট ৬বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।


সূত্র জানিয়েছে, পিডিবির নিজস্ব উৎপাদন ব্যয় এখনও গড়ে ৩ টাকার নিচে রয়েছে। কিন্তু তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৮ টাকা। নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় যোগ করেই পিডিবির গড় ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেছে।

বিইআরসি সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গড়ে ৬ টাকা। এ বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ম. তামিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মূলত তেলভিত্তিক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ না হবে ততদিন এ সমস্যা থাকবেই।

সমস্যা সমাধানে কোনো বিকল্প আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে। তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক (দেশি বা বিদেশ থেকে আমদানি) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তাহলেই উৎপাদন খরচ কমবে।’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন খরচ বাড়বে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’

নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুনানিতে অংশ নেব, দেখব তারা কোন পারপাসে দাম বৃদ্ধি করে। তাদের প্রস্তাবের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়গুলো দেখে এর বিরোধিতা করব।’ এ জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক শামসুল আলম।

জ্বালানি বিশ্লেষকরা বার বার বলছেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টালের কারণেই মূলত বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং তা জনগণের উপর চাপানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে বিইআরসির চেয়ারম্যান আর এ খান বলেন, ‘রেন্টাল-কুইক রেন্টাল স্থায়ী কোনো পদ্ধতি নয়, এটি সাময়িক। বিশ্বের কোথাও এটি স্থায়ী নয়। কয়লাভিত্তিক নতুন পাওয়ার প্লান্ট বা পুরনো পাওয়ার স্টেশনগুলো সংস্কার করে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতে পারে।’

জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে মোট ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ মার্চ বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরপর ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাইকারি পর্যায়ে ১১ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করা হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট পাইকারি পর্যায়ে কার্যকর হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের মাথায় ১ ডিসেম্বর খুচরা পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। ৯ মাসের মাথায় গত ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারিতে বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানি শেষে পিডিবির ১২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপরীতে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ওজোপাডিকোর ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশের বিপরীতে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ, ডেসকোর ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, ডিপিডিসির ১১ দশমিক ৩১ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছিল পিডিবির জন্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৮৬ পয়সা, ডিপিডিসি ৬ টাকা ৩৫ পয়সা, ডেসকো ৬ টাকা ৪৫ পয়সা, ওজোপাডিকো ৫ টাকা ৮২ পয়সা এবং আরইবির জন্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪)