মাসুদ রানা, দ্য রিপোর্ট : ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীকে ফেরত নিতে হবে। এজন্য ক্রেতাকে পণ্য মূল্য অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট হারের অর্থ বিক্রেতার কাছে জামানত হিসেবে জমা রাখতে হবে। ক্রেতা ই-বর্জ্য ফেরত দিলে বিক্রেতা জামানতের টাকা মুনাফাসহ ফেরত পাবেন।

এমন নিয়ম রেখে ‘ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য হতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৭’ এর খসড়া করেছে সরকার।

খসড়া বিধিমালায় পণ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্বে বলা হয়েছে, ইলেক্ট্রনিক পণ্য বা যন্ত্রপাতি বিক্রির সময় প্রত্যেক প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের উপর একটি হারে (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) অর্থ জামানত হিসেবে রাখবে। ই-পণ্য মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বা ব্যবহার শেষে ফেরত দেওয়ার সময় বিক্রেতা জামানতের অর্থ প্রচলিত হারে সুদ বা মুনাফাসহ ফেরত দেবে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) মো. নুরুল করিম দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মতামতের জন্য ই-বর্জ্যের খসড়া বিধিমালা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও এনজিওগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মতামত পাওয়ার পর আমরা সেগুলো পরিবেশ অধিদফতরে পাঠাব। এরপর খসড়া চূড়ান্ত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হবে। শেষে এটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হবে।’

ই-বর্জ্যের বিষয়টি আমাদের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন বিষয় জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যারা উৎপাদন করবে ই-বর্জ্যের দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। সেখানে ক্রেতাকেও সহযোগিতা করতে হবে।’

বিধিমালার কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’ এর ১৫ (২) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে।

দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ২ থেকে বছরের কারাদণ্ড বা ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব অনুমোদনের সময় ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।

সম্প্রসারিত দায়িত্বের বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীকে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ১৫ শতাংশ ফিরিয়ে নিতে হবে।

দ্বিতীয় বছরে ২৫ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩৫ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ই-বর্জ্যের ৫৫ শতাংশ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করায় ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-বর্জ্য নতুন বিষয় হওয়ায় এ বিষয়ে সচেতনতাও কম, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান বিষাক্ত উপাদান যেমন সীসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, মস্তিস্ক, হৃদযন্ত্র ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। ই-পণ্য সামগ্রী ব্যবহারের ক্রম ঊর্ধ্বমুখিতায় ই-বর্জ্যের পরিমাণ ও ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

বিভিন্ন স্তরে সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব

খসড়া বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী, ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মেরামতকারী, সংগ্রহ কেন্দ্র, ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় ব্যবহারকারীর/প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা, চূর্ণকারী ও পুনঃব্যবহারকারীর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রস্তুতকারক ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতের সময় উৎপাদিত যে কোনো ই-বর্জ্য পুনঃব্যবহারোপযোগী বা ধ্বংস করার জন্য সংগ্রহ করবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত সব ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য রাখার জন্য উৎপাদনকারী ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমন্বিতভাবে সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করবে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট ই-বর্জ্যের পরিবেশসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থাও করবে উৎপাদনকারী।

খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীকে প্রত্যেক অর্থবছর শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বা এর আগে ই-বর্জ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদফতরে দিতে হবে।

প্রত্যেক ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার ভোক্তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত স্থানে ই-বর্জ্য সংগ্রহের করবেন। তবে এমন পণ্য সংগ্রহের স্থানের অবস্থান জলজ সম্পদ বা জলাশয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে হবে।

প্রত্যেক মেরামতকারী মেরামত প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে তা অনুমোদিত সংগ্রহ কেন্দ্রে পাঠাবে।

বিধিমালা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত বা ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্য বা এর অংশবিশেষ ভাঙার কাজে নিয়োজিত তিনি হচ্ছেন চূর্ণকারী। চূর্ণকারীকে অবশ্যই পরিবেশ অধিদফতরের নিবন্ধন ও ছাড়পত্র নিতে হবে।

ভোক্তাকে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী বা সংগ্রহ কেন্দ্রে ই-বর্জ্য জমা দিতে হবে। ভোক্তারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আইনে নির্ধারিত জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণ দিতে হবে

ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, সংগ্রহ কেন্দ্র, পরিবহনকারী, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারীর দায়িত্ব অনুযায়ী পরিবেশগত বা জনস্বাস্থ্যের যে কোন ক্ষতির জন্য দায়ী হবে। এক্ষেত্রে এদের নিজ অর্থে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বা ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবেশগত উপাদান পুনরুদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

নিবন্ধন নিতে হবে

বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মজুদকারী, পরিবহনকারী, মেরামতকারী, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী, নিলাম বিক্রেতা ও রফতানিকারককে পরিবেশ অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

দেশে ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে রফতানিকারক পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে তা বিদেশে রফতানি করতে পারবে বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।


ই-বর্জ্য ১২০ দিনের বেশি মজুদ নয়

প্রত্যেক প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী ই-বর্জ্য ১২০ দিনের বেশি মজুদ রাখতে পারবে না। এদের ই-বর্জ্য সংগ্রহ, বিক্রি, হস্তান্তর, মজুদ এবং বিভাজন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর তদন্তে এলে এ সব তথ্য উপস্থাপন করতে হবে।

তবে পরিবেশ অধিদফতর শর্ত সাপেক্ষে ই-বর্জ্য মজুদকরণের সময় বর্ধিত করতে পারবে।

বিপদজনক পদার্থ ব্যবহারের মানমাত্রা অনুসরণ

প্রত্যেক ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারককে পণ্য উৎপাদনে বিপদজনক পদার্থ (এন্টিমনি ট্রাইওয়াক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম মেটাল, ক্যাডমিয়াম সালফাইট ইত্যাদি) ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিমালায় উল্লেখিত মানমাত্রা অনুসরণ করতে হবে। এ বিধিমালা কার্যকর হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে বিপদজনক পদার্থ ব্যবহার হ্রাসকরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।

দাতব্য, অনুদান বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো পুরাতন বা ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি অনুমোদন করা হবে না।

প্রতিবেদন দেবে পরিবেশ অধিদফতর

বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় অফিস প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত ফরম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয় বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন একত্রিত করে তা পুনঃপরীক্ষা ও দিক-নির্দেশনার জন্য প্রতিবছর ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এস/এপি/এপ্রিল ১৮, ২০১৭)