বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষক ও গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন। সম্প্রতি দেশের কৃষক, কৃষিপণ্য ও কৃষি ব্যবসার নানা সমস্যা ও এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাকৃবি প্রতিনিধি মো. আউয়াল মিয়া।

 

দ্য রিপোর্ট : দেশের কৃষি ও কৃষকের সমস্যা প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। সবুজঘেরা ও শস্য শ্যামলা দেশ আমাদের বাংলাদেশ। সবুজ শস্যকে ঘিরে রয়েছে কোটি কোটি কৃষক। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই কৃষকেরা নানা কারণে কৃষি দ্রব্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। ফলে তারা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। এভাবে কৃষি পেশা থেকে কৃষকেরা অন্য পেশায় চলে গেলে হয়তো দেশে আবারও খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। তাই অতি দ্রুত কৃষিবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিদ্রব্যের সঠিক দাম নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে। কৃষকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে ও কৃষক বাঁচবে।

দ্য রিপোর্ট : কৃষকেরা কি কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না বলে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : এ ক্ষেত্রে কৃষকের সঠিক পরিকল্পনার অভাব মূলত দায়ী। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। উৎপাদিত পণ্যের গুরুত্বের পাশাপাশি বাজারকে গুরুত্ব না দেওয়ায় কৃষকেরা সঠিক দামে ফসল বিক্রি করতে পারছে না।

দ্য রিপোর্ট : ঠিক কি কি পদক্ষেপ নিলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন করার পাশাপাশি বিকল্প শস্য চাষ করা, জমির বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ না করা, চাল করে বিক্রি না করা, কৃষি পণ্যের বাজারজাত করা ও কৃষি ব্যবসা সম্প্রসারণ করলেই ন্যায্যমূল্য পেতে পারে। কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলেও উৎপাদন কিন্তু কমেনি। বরং উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে। দেশের বাইরে আমাদের কৃষিপণ্য রফতানি হচ্ছে। অথচ এই কৃষকরা ন্যায্যমূল্য ও প্রাপ্ত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষিপণ্য বিতরণের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী কমাতে হবে। কৃষি ব্যবসা প্রসার করা ও কো-অপারেটিভ মার্কেট ( অনেক কৃষক মিলে যে মার্কেট তৈরি) গঠন করে দাম নির্ধারণ করতে হবে।

দ্য রিপোর্ট : উৎপাদন ব্যয় কীভাবে কমানো যেতে পারে -এ বিষয়ে আপনার অভিমত?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। পরিবারের শ্রমিক ব্যবহার করেও উৎপাদন ব্যয় কমানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে কৃষকরা যদি কৃষি অর্থনীতিবিদদের সহায়তা নেয় তাহলেও ব্যয় অনেকাংশেই কমানো যেতে পারে।

দ্য রিপোর্ট : কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রে কৃষকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : ধান, ডাল, গম, তেলবীজ, যব, আলু, মশলা, ভুট্টা, তামাক, শাক-সবজি, ফলমূল, চা, আখ, পাট, তুলা, রেশম, রাবারসহ সব ধরনের কৃষিজাত দ্রব্য কৃষকরা উৎপাদন করে। এই সকল দ্রব্য থেকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা যায়। যেগুলোর চাহিদা বাজারে রয়েছে। দেশের বেশিরভাগ শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যের কাঁচামাল সিংহভাগই আসে কৃষি থেকে। বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প ও কুটির শিল্পের কাঁচামাল। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত দ্রব্য রফতানি করে আয় হয়। সরকারের আয়ের বিরাট অংশও কৃষিখাত থেকে আসে। তাই কৃষকদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলে মিলে যদি বিপুল পরিমাণ দ্রব্য সঞ্চয় বা জমা করে রাখতে পারে তাহলে তাদের দাম নির্ধারণের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। এভাবে কৃষকেরা বেশি দাম পেতে পারে।

দ্য রিপোর্ট : কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য আসলেই কি মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য অবশ্যই মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে। তবে এদের সংখ্যাটা কমাতে হবে। কারণ, কৃষকের পক্ষে দর কষাকষি সম্ভব হয় না। কৃষিপণ্য বড় বাজারে ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিতরণের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে।

দ্য রিপোর্ট : অধিকাংশ মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যাওয়ার মূল কারণটা কি বলে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় মূলত এমনটা হয়। কারণ, একটি পণ্য যত হাতবদল করবে সেই পণ্যের ক্ষেত্রে তত মূল্য যোগ হবে। আমাদের দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। ফলে মুনাফাগুলো মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যায়।

দ্য রিপোর্ট : সুষম বণ্টন অর্থনীতিতে উৎপাদক ও ভোক্তাদের বাজার কেমন হওয়া উচিত?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : সুষম বণ্টন অর্থনীতিতে উৎপাদক ও ভোক্তাদের বাজার অবশ্যই ‘আদর্শ বাজার’ হওয়া উচিত। সেই সাথে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার হলে ভাল হয়; যদিও এটা পুরোপুরি সম্ভব না। তবে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করে উৎপাদনকারীরা ভাল দামে বিক্রি করবে এবং ভোক্তারা কম দামে পণ্যের সর্ব্বোচ উপযোগ ব্যবহার করবে।

দ্য রিপোর্ট : কৃষি ভর্তুকিতে প্রকৃতপক্ষে কি কৃষকরা লাভবান হচ্ছে বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : ইউরিয়া সারের ক্ষেত্রে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তবে সার, বিদ্যুৎ ও সেচযন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হচ্ছে।

দ্য রিপোর্ট : মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে কৃষিপণ্য ও কৃষিবীজের বাজার চলে গেছে। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে? বিষয়টি যদি একটু বিশদভাবে বলেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : এখনো পুরোপুরি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে কৃষিপণ্য ও কৃষিবীজের বাজার চলে যায়নি। তবে প্রক্রিয়াজাত পণ্য, বীজ ও ইনপুট ফ্যাক্টরগুলো কিন্তু তাদের হাতে। এটা জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এটা কৃষকদের জন্য ভবিষ্যতে দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

দ্য রিপোর্ট : নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বাড়লেও দ্রব্যর দাম কমছে না কেন? এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই এমনটা হচ্ছে। পণ্য গুদামজাত করে রেখে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এজন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বাড়লেও দ্রব্যের দাম কমছে না।

দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা, দেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি বিপণন কি রকম হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষি বলতে মানুষের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণিজ সম্পদ উৎপাদন করাকেই বোঝায়। তাই কৃষি হচ্ছে এক ধরনের কাজ যা শস্য উৎপাদন, পশু-পাখি পালন, মৎস্যচাষ, বনায়ন প্রভৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির উন্নয়ন মানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন। জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের প্রায় ৬০ ভাগ লোক এই কৃষির পেশায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা প্রায় ১৭ শতাংশ আসে এই কৃষি খাত থেকে। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাক-সবজিসহ মাছ, ডিম, দুধ প্রভৃতি খাদ্য জনগণের খাদ্য চাহিদাসহ যাবতীয় চাহিদা পূরণ করা করে। শিক্ষা ছাড়া মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোও এই কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের অধিবাসীরা পশুপালন করে আসছে। কৃষিকাজ পরিচালনা, পরিবহন, মাংস ও দুধ সরবরাবহ, পশমী বস্ত্র তৈরি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে আমাদের গ্রামাঞ্চলের লোকেরা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়াসহ গবাদি পশুপালন করে থাকে। তবে বেশি শস্য উৎপাদনের জন্য জমি, শস্যাদির স্থানান্তর, দুধ ও মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে গবাদি পশুর চাহিদা বর্তমানে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য পশুপালন একটি লাভজনক পেশা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দেশের অনেক বেকার লোক পশুপালনসসহ হাঁস-মুরগি ও কোয়েল পালনও স্বকর্মসংস্থানের অন্যতম উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

সমসাময়িক সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে মাছ চাষ স্বকর্মসংস্থানের একটি অন্যতম উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এ পেশায় জড়িত হচ্ছে। তারা পুকুর, দিঘিতে মাছ চাষ করছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মাছ চাষের কলাকৌশল অনেক উন্নত হয়েছে। দ্রুত বর্ধনশীল নতুন নতুন প্রজাতির মাছ এ দেশে আনা হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। পোনা উৎপাদন বা হ্যাচারির মাধ্যমেও অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এ ছাড়া বর্তমানে বনায়ন, নার্সারি, ফুলের বাগান করে আমাদের দেশের বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশের প্রেক্ষাপটে কৃষিপণ্য যেন সঠিক দামে বিক্রি হয় সেইরকম বাজার হওয়া উচিত।

দ্য রিপোর্ট : কৃষি উন্নয়নে সরকারের প্রতি কোনো পরামর্শ আছে কিনা?

ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে। কৃষকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে ও কৃষক বাঁচবে।

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/এপি/এনআই/এপ্রিল ১৮, ২০১৭)