‘জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে’- চিরন্তন এ সত্য খণ্ডনের সুযোগ নেই। কিন্তু মৃত্যুর পর লাশ সঠিকভাবে দাফনের অধিকার সর্বজনীন। আর সেই লাশ যদি হয় বেওয়ারিশ, তার দাফনের দায়ভার রাষ্ট্র অথবা স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু রাষ্ট্র কি বেওয়ারিশ লাশের প্রতি সেই দায়িত্ব পালন করছে? করছে না! দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত গত দেড় বছরে অন্তত ১০০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়নি। এমনকি হাসপাতাল, কবরস্থান ও পুলিশের খাতায় বেওয়ারিশ লাশের হিসাবেও গরমিল দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে বেওয়ারিশ লাশ বিক্রি করা হয়। একাধিক চক্র এ লাশগুলো সাধারণত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এমনকি মেডিকেল কলেজ ও কবরস্থানকেন্দ্রিক চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলের অসাধু চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধারের পর থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু বা আনন্যাচারাল ডেথ (ইউডি) মামলা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফনের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বের সঙ্গে লাশের আনুষ্ঠানিক সকলপ্রকার কাজ সম্পন্ন করে আজিমপুর বা জুরাইন কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করতে পাঠায়। কিন্তু এরপর লাশগুলো দাফন করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে কেউ তদারকি করে না।

দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধান ও বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত লাশের দাফনের ক্ষেত্রে প্রতিমাসে ১০-১২টির হিসাবে অসঙ্গতি রয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালের জুলাই মাসে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন তালিকায় লাশের সংখ্যা ১১৩। এ মাসে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ৪২টি এবং ৫৯টি আজিমপুর কবরস্থানে। বাকি ১২টি লাশের কোনো হিসাব নেই। আগস্টে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন তালিকায় লাশের সংখ্যা ১২৮টি। এর মধ্যে জুরাইন কবরস্থানে ৮৯টি ও আজিমপুরে দাফন করা হয় ১৮টি। এ মাসে ২১টি লাশের হিসাব মিলছে না। এভাবে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও ডিসেম্বর এবং ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মোট ৮৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়নি। সে সব লাশ কোথায় গেছে তারও কোনো তথ্য নেই।

একই সঙ্গে জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পাঠানো লাশের থেকে বেশি লাশ দাফন করার তথ্যও পাওয়া গেছে। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম থেকে ১৪৫টি লাশ দাফন করার জন্য পাঠানো হয় জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে। কিন্তু জুরাইনে ১১২ ও আজিমপুরে ৩৭টি লাশ দাফন করা হয়। এ মাসে চারটি লাশ বেশি দাফন করা হয়েছে। একই ভাবে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১৬টি, মে মাসে ৬টি এবং জুনে ৭টি লাশ বেশি লাশ দাফন করা হয়।

রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দায়িত্বরত নুরুল হুদা বলেন, ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন-২০১৩ পর্যন্ত ৪০০টি এবং ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬৩টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। জুরাইন কবরস্থানে দায়িত্বরত মাওলানা মো. সোয়াইব হোসেন বলেন, গত দেড় বছরে জুরাইন কবরস্থানে এসেছে ১০৪৭টি অজ্ঞাত লাশ।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সাভির্স) আবদুল হালিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা থেকে বেওয়ারিশ লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে আনা হয়। পুলিশ, সরকারি হাসপাতাল ও রেলওয়ে থেকে পুলিশ মারফত লাশগুলো সংগ্রহ করা হয়। বেওয়ারিশ লাশ জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থান ছাড়া অন্য কোথাও দাফন করা হয় না। লাশের হিসাবে কোনো গরমিল হওয়ার কথা নয়। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আগে কখনও ওঠেনি।’ লাশের হিসাবে অসঙ্গতি সর্ম্পকে তিনি আরও বলেন, ‘লাশ দাফন না হওয়ার কিছু নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অধিংকাশ সময় লাশ আনা হয়। তা সঠিকভাবেই দাফন করা হচ্ছে। লাশ দাফন না করার কিছু নেই।’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কঙ্কাল ও মানবদেহ বিক্রি সম্পর্কে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান জুবায়েদ আহমেদ বলেন, ‘বেওয়ারিশ লাশগুলো হাসপাতাল থেকে পুলিশকে দেওয়া হয়। পুলিশ কি করে সে বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু জানে না। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যদানের জন্য মানবদেহ অথবা বেওয়ারিশ লাশ সংগ্রহের বিষয়টিও আমি সঠিকভাবে জানি না। কোনো না কোনোভাবে যেমন লাশ সংগ্রহ হয়, তেমনি কঙ্কালও কেনে শিক্ষার্থীরা।’

অজ্ঞাত লাশ দাফন করা হচ্ছে না- এমন তথ্য পুলিশের কাছেও নেই। বলা চলে, পুলিশ এ প্রসঙ্গে কখনও তদারকি করার প্রয়োজন মনে করছে না। এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরির্দশক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘এমন ঘটনা অসম্ভব। যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এইচএসএম/এজেড/আরকে/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪)