শ্রমিকের জন্য সরকার ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দিয়েছে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। বাংলাদেশের শ্রম আইনে একজন শ্রমিকের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা। কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়ন নেই শতভাগ।


শ্রমিকের মজুরি নিয়ে দেশে যেমন রয়েছে নানা বৈষম্য, তেমনি সরকার নির্ধারিত ৫ হাজার ৩০০ টাকার ন্যূনতম মজুরিও শতভাগ বাস্তবায়িত নেই বলে শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ শ্রমিককেই তার নির্ধারিত ৮ কর্মঘণ্টার বেশি সময় কাজ করানো হয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, মাসে কমপক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা মজুরি না দিলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে টিকে থাকাও অসম্ভব। শ্রমিক-কর্মচারীরা যে মজুরি পান, তা অপর্যাপ্ত। বেশিরভাগই স্বামী ও স্ত্রী মিলে কাজ করে কোনোমতে টিকে থাকছেন। কেউবা ঋণের দায়ে জর্জরিত হচ্ছেন। এই শ্রেণির মানুষ জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে বড় ধরনের আপস করছেন।

‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৬০ লাখ। প্রতিবছর ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে। আর বেকার লোকের সংখ্যা ২৬ লাখ। দেশের বেকাররা যেমন ভালো নেই, তেমনি কর্মজীবী অনেকে যে বেতন পান, তা দিয়ে নিজের ও পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারেন না।

২০১৩ সালে সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতর সরকারের এই আইন বাস্তবায়ন করে থাকে। সরকারি এই সংস্থাটির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দুই হাজার ৩৬০টি কারখানার (বিজিএমইএ, বিকিএমইএ ও সমিতি বহির্ভূত) পরিদর্শন করা হয়। তাতে দেখা যায়, মজুরি নিয়মিত পরিশোধ করেছে ৯১ শতাংশ কারখানা। আর সরকার ঘোষিত মজুরি কাঠামো তথা ন্যূনতম মজুরি অনুসরণ করেছে ৮৮ শতাংশ কারখানা। গার্মেন্টস সেক্টরে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। কিন্তু প্রতিবেদনে দেখা গেছে ৬৭ শতাংশ কারখানা প্রসূতি কল্যাণ ছুটি ও ভাতা প্রদান করেছে।

শ্রম পরিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকরা শ্রম দিচ্ছেন দেশে এমন খাতের সংখ্যা মোট ৬৭টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাকখাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতি। বাকি খাতগুলো হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণখাত, ইটের ভাটা, চা শিল্প, বই বাঁধাই, রাইস মিল বা চাতাল, হস্তচালিত তাঁত, ক্ষুদ্র ও ধাতবশিল্প, তামাকশিল্প, দোকান-প্রতিষ্ঠান, ট্যানারি, টোব্যাকো, স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হোসিয়ারি, দর্জি, স’মিল, মৎস্য ও মৎস্য খামার, রাবার, পোলট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ফেরিওয়ালা, জেলে, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি, সেলুন, দোকান ও বিউটি পার্লার, প্রিন্টিং প্রেস, ডক অ্যান্ড পোর্ট, ফার্নিচার, সড়ক, জুট, জুট প্রস ও জুট বেলিং, খাদ্য, পাদুকা, ম্যাচ, নার্সারি, ডেকোরেটর, স্বর্ণকার, ওষুধ, পাওয়ার লুম স্পিনিং মিল, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ অন্যতম।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য মতে, দেশে মোট ৪৩টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ খাতে তা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তা সর্বত্র পরিপালন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, গার্মেন্টস এ হেলপারদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা ধরা হয়েছে। ৫ শতাংশ হারে প্রতিবছর তাদের বেতন বৃদ্ধি পায়। তবে অন্যান্য পদে কর্মরতদের বেতন এর চেয়ে অনেক বেশি। তার মতে, গার্মেন্টস সেক্টরে অনেক জায়গায় বেতন বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র কারখানা যারা বিজিএমইএ ও বিকিএমইএর সদস্য নয়, সেসব কারখানার শ্রমিকরা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম বেতন পায় না। ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা অনেকক্ষেত্রে তারা বেতন পায়।

গার্মেন্টস সেক্টর তো বটেই এর বাইরে নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, গৃহকর্মী, ঘাট শ্রমিকসহ অনেক খাতেই ন্যূনতম মজুরির শতভাগ বাস্তবায়ন নেই। আর অপ্রাতিষ্ঠানিকখাত তথা সবচেয়ে বেশি শ্রমিক যেখানে কর্মরত সেই কৃষি শ্রমিকদের এখন পর্যন্ত মজুরি বোর্ডের অধীনেই আনা হয়নি।

‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ এই প্রতিবাদ্য বিষয়ে এবার পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। তবে সরকারি এই স্লোগানের পাশাপাশি ‘শিল্পের উন্নয়ন শ্রমিকের অধিকার, বাড়াবে মর্যাদা সবার’ এই শিরোনামে শ্রমিক সংগঠনগুলো দিনটিকে পালন করছে।

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্যমূল্য এবং দৈনিক অনধিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। আন্দোলন নস্যাৎ করতে এক পর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে নিহত শ্রমিকের রক্তে ভিজেছিল শিকাগোর রাজপথ। শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ৬ শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহত্যা করেন এক শ্রমিক। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেশের ৮০ শতাংশ শ্রমিককে ৮ কর্মঘণ্টার বেশি সময় কাজ করানো হয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।

মে দিবসের আগে পাঁচটি শ্রমঘন খাতের শ্রমিকদের কাজের তথ্য বিশ্লেষণ করে রবিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে আসা প্রতিষ্ঠানটি।

নিরাপত্তাকর্মী, পরিবহনকর্মী, হোটেল/রেস্তোরাঁ শ্রমিক, রি-রোলিং মিলের শ্রমিক এবং হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শ্রমিকদের নিয়ে এই গবেষণাটি চালায় বিলস। বিলস কার্যালয়ে ‘শ্রম পরিস্থিতি-২০১৬ : শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, দূরপাল্লার পরিবহন খাতের শতভাগ শ্রমিকই দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এছাড়া রি-রোলিং এর ৯২ ভাগ, হোটেলের ৯৮ ভাগ, হাসপাতালের ৪২ ভাগ ও নিরাপত্তাকর্মীদের ৮০ ভাগ শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এসব শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ছুটি থেকেও বঞ্চিত হন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নিরাপত্তাকর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না; ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে ছুটি পান না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। পরিবহন শ্রমিকদের ৯০ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, ৯৮ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে, ৮৪ ভাগ মে দিবসে ছুটি পান না। হোটেল শ্রমিকদের ৮৬ শতাংশ সাপ্তাহিক ছুটি, ৮২ শতাংশ সরকারি ছুটি ও ৮২ শতাংশ মে দিবসের ছুটিতেও কাজ করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রি-রোলিং শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের কাজ করতে হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসেও। হাসপাতালের শ্রমিকদের ৫০ শতাংশ সরকারি ছুটিতেও কাজ করেন, সাপ্তাহিক ছুটি নেই ৭২ শতাংশের।

গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ২৮ জন নারীসহ কর্মক্ষেত্রে ৬৯৯ জন শ্রমিক নিহত হন। এছাড়া আহত হন ৭০৩ জন শ্রমিক। অন্যদিকে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৮৯ জন শ্রমিক, যার মধ্যে নারী শ্রমিক ছিলেন ৪০ জন। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নারীসহ ১৪৯ জন শ্রমিক নিহত হন। বিভিন্ন কারখানায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ২৩৭টি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, শ্রম নিরাপত্তার যে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তা জীবনের নিরাপত্তার না, ব্যবসার জন্য করা হয়েছে। এই উন্নতি করা হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যকে নিরাপদ করার জন্য। আইন সব জায়গায় সমান হওয়া উচিত। কারণ জীবনের নিরাপত্তাকে কখনও ভাগ করা যায় না। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য শ্রমিকদের এক ধরনের নিরাপত্তা, আর প্রান্তিক শ্রমিকের জন্য আরেক ধরনের নিরাপত্তা থাকতে পারে না।

এদিকেশ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি সুযোগ থাকলেও মালিকপক্ষের নানা তৎপরতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সংগঠিত হতে পারছেন না। আবার স্বার্থের বিরোধ ও রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় তেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন না শ্রমিক নেতারাও।

শ্রমিকনেতা ওয়াজেদুল ইসলাম বলেন, পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন আছে কমপক্ষে ৫৬টি। এ ছাড়া সব খাত নিয়ে কাজ করে এমন জোট, ফেডারেশন বা ইউনিয়ন আছে কমপক্ষে ৩১টি। এভাবে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হচ্ছেন শ্রমিকরা। তার মতে, হয়রানি ও চাকরিচ্যুতির ভয়ে অনেক শ্রমিক এখন ট্রেড ইউনিয়ন না করে চুপ করে থাকেন।

এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সরকারি হিসেবে মোট শ্রমশক্তির ১২ দশমিক ৬ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকখাতে। ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতের বেশিরভাগই কৃষিতে নিয়োজিত। তৈরি পোশাকখাতের একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন এখন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা করার দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এই খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে আনুষ্ঠানিক ৪২টি খাত রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত পাঁচ বছর পর কমিশন গঠন করে। এর বাইরে অন্য খাতগুলো চাহিদা জানালে তা নিম্নতম মজুরি বোর্ডে পাঠানো হয়। বোর্ড শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা সাপেক্ষে মজুরি নির্ধারণ করে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/এনআই/এপ্রিল ৩০, ২০১৭)