বিধান সরকার, বরিশাল : প্রসূতি মায়েদের নিরাপদে সন্তান প্রসব হার বেড়েছে বরিশালের কমিউনিটি ক্লিনিকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপদ প্রসব সেবার প্রশিক্ষণ দেওয়াতে এই সংখ্যা বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ গুণ।

কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসব সেবা পাওয়াতে অনেক সুবিধা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপকারভোগী সদর উপজেলার শিবপাশা গ্রামের বড় আরিন্দাবাড়ির গৃহবধূ মিনা বেগম (২৪)।

পর্যায়ক্রমে সব কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসব সেবার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা হবে বলে বরিশালের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়।

সিভিল সার্জনের দফতর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জেলায় প্রস্তাবিত কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা ৩০১টি। এরমধ্যে ২৭৯টি চালু রয়েছে আর ১টি ক্লিনিক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। চালু থাকা ক্লিনিকগুলোয় নিয়োগপ্রাপ্ত ২৭০ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার কর্মরত আছেন। নিরাপদ প্রসব সেবার জন্য ২০১৪ সালে কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেন্ডেন্ট (সিএসবিএ) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), স্বাস্থ্য সহকারী এবং পরিবার কল্যাণ সহকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সদর উপজেলার শোলনা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি আনোয়ারা পারভিন বলেছেন, ‘প্রতি ব্যাচে ২০ জন করে মোট ৬০ জনকে ৬ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল নিরাপদ প্রসব সেবার বিষয়ে। এরমধ্যে জেলায় ৫৬ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার এই প্রশিক্ষণ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন অফিসের কীটবিষয়ক কুশলী সানজিদা হোসেন। তিনটি ব্যাচের পর সিএইচবিএ প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে।’

গাওয়াসার কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি সাদিয়া আফরিন মৌরি জানিয়েছেন, গর্ভধারণের পর থেকে তারা এন্টিনেটাল চেকআপ (এএনসি) করান। প্রথমে ৪ মাসের বেলায় এরপর ৬, ৮ ও ৯ মাস মিলিয়ে মোট ৪ বার প্রসব পূর্ববর্তী সেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে আসতে বলা হয়। এ সময় রক্তচাপ মাপা, রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়। ৫টি বিপদচিহ্ন সম্পর্কে বোঝানো হয়। কি খাবার খাবেন, দিনে ২ ঘণ্টা বিশ্রাম ও রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো, সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ভিটামিট ওষুধ কার কতটুকু খেতে হবে এসব পরমার্শ দেওয়া হয়। এই সেবার পরিধি শূন্য থেকে এক হাজার দিবস পর্যন্ত।

গর্ভবতী নারীদের কাছে স্বাস্থ্যকর্মীদের মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকায় তারা প্রসবের সময় হলে ফোন করেন। রোগীর অবস্থা দেখে তারা ব্যবস্থা নেন। কখনো বা হাসপাতালে রেফার্ড করেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, প্রসব পরবর্তীতে তারা মায়েদের পোস্ট নেটাল চেকআপ (পিএনসি) করিয়ে থাকেন। সন্তান প্রসব পরবর্তী ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত মাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে তাদের এই সেবা। এটি প্রত্যেককেই বলে দেওয়া হয় শিশু ভূমিষ্ঠের এক ঘণ্টার মধ্যেই শাল দুধ খাওয়ানো আর ছয় মাস অবধি এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত মুখে দিতে বারণ করা হয়।

সম্প্রতি শোলনা কমিউনিটি ক্লিনিকে গেলে সেখানের সিএইচসিপি আনোয়ারা পারভিন যিনি ধাত্রীবিদ্যায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, নিয়ে যান শিবপাশা গ্রামের আরিন্দা বাড়িতে। যাওয়ার পথে শোনান, তিনি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ৩টি ডেলিভারি নিজে করিয়েছেন। ৭-৮টিতে করেছেন সহায়তা। এখন তাদের সাথে পরামর্শ করে কী করতে হবে সিদ্ধান্ত নেন গর্ভবতী নারীর পরিবার। আরিন্দা বাড়ি ও হাওলাদার বাড়ির দুই গর্ভবতী নারীর নিরাপদে সন্তান প্রসব করিয়েছেন সিএইচসিপি আনোয়ারা বেগম। এদেরই একজন মিনা বেগম (২৪)। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তার সন্তানের জন্ম হয়। তখন বর্ষা মৌসূম। চারদিক পানিতে তলানো। হাসপাতালের যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। আর ক্লিনিকে গেলে ডাক্তার সিজার করিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিত। সিএইচসিপি আনোয়ারা পারভিনকে দেখিয়ে বলেন, তার সহায়তায় আমি নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পেরেছি। এ সময় এই বাড়ির সুফিয়া লিলি, সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, হাসাপাতল বা বেসরকারি ক্লিনিকে গেলে ভোগান্তির চেয়েও বড় সমস্যা সিজার করানোর টাকা জোগাড় করা। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকায় অনেক উপকার হয়েছে।

নিরাপদ প্রসবের কথা বিবেচনা করে এখন নতুন করে যেসব কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি হচ্ছে তা ৮ শতক জমির ওপর নির্মাণ হচ্ছে। এখানে প্রসবের জন্য আলাদা রুম তৈরি করা হয়েছে। বরিশাল সদর উপজেলায় দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে যেখানে সন্তান প্রসবের উপযুক্ত ব্যবস্থা আছে বলে জানালেন সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. যতীন চন্দ্র রায়। ২৪ এপ্রিল অবসর নেওয়া সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম শফিউদ্দিন বলেছেন, গ্রামে অদক্ষ ধাত্রী দ্বারা সন্তান প্রসব হওয়াতে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এই হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল এমডিজিতে। এটা আমরা কিছুটা অর্জন করতে পেরেছি। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) কথা চিন্তা করেই সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকে নিরাপদ প্রসবের ব্যবস্থা রেখেছেন। এতে করে আমরা চাচ্ছি ৫০ ভাগ ডেলিভারি যেন দক্ষ কর্মী দ্বারা করাতে পারি। আমাদের টার্গেট ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখে জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর নিচে নিয়ে আসব। শিশু মৃত্যুর হার ৫ বছরের কম বয়সীদের বেলায় ২৫-এর নিচে নিয়ে আসার। ডা. এ এফ এম শফিউদ্দিন আরো জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রসব সেবা বাড়ানো গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবে।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এপি/মে ০২, ২০১৭)