দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দাবি ছিল ১৩ দফার। সেই ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে অবস্থান কর্মসূচিতে গিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বহু হেফাজতকর্মী হতাহত হয়েছে বলে দাবি করা হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। শুক্রবার (৫ মে, ২০১৭) এ ঘটনার চার বছর পূর্তি। এই চার বছরের ব্যবধানে বর্তমানে হেফাজেতের সঙ্গে সরকারের সু-সম্পর্ক লক্ষণীয়। সম্প্রতি হেফাজত ও বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও হেফাজত উভয়ের স্বার্থে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে। তবে আস্থা-অনাস্থার বিষয়টি এখনো বিদ্যমান রয়েছে উভয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে।

১৩ দফা দাবিতে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচিকে ঘিরে ওই দিন দুপুর থেকে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পাশাপাশি, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ আরও কয়েক স্থানে সংঘর্ষে হেফাজতের ২২ নেতাকর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হয় বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানানো হয়। সেদিন পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।

এ ঘটনায় ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় মোট ৮৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে ৫৩টি মামলা হয়। ৮৩ মামলায় তিন হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। তবে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীকে কোনো মামলাতেই আসামি করা হয়নি। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ অনেক নেতাকর্মীকে। এরপর আত্মগোপনে চলে যান বাকি নেতারা। স্তিমিত হয়ে পড়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক এই সংগঠনটির কার্যক্রম।

ওই বছর ৫ ও ৬ মে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা ৮৩টি মামলার মধ্যে ১৫টি মামলায় ২০১৪ সালে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯টি মামলার তদন্ত চলছে। এসব মামলায় প্রায় আড়াই শ’ হেফাজত নেতার নামসহ অন্তত ৪০ হাজার জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের অনেকেরই নাম ঘুরেফিরে প্রায় সব মামলায় রয়েছে। বাগেরহাটে একটি মামলার রায়ে প্রায় ৪০০ আসামি খালাস পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

‘ইসলাম অবমাননা কটূক্তিকারীদের মৃত্যুদণ্ডের আইন, ইসলামবিরোধী নারী নীতিমালা ও শিক্ষানীতি’ পরিবর্তনসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে ওই দিন রাতে সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। এ ছাড়া ২০১৬ সালে পাঠ্যবইয়ে ১৭টি বিষয় সংযোজন ও ১২টি বিষয় বাতিলের সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করেছিল সংগঠনটি। ২০১৭ সালে নতুন পাঠ্যবই প্রকাশের পর দেখা গেছে এসব সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। হেফাজত এ জন্য সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ‌ও জানিয়েছে।

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজত নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন। বেশির ভাগ নেতাকর্মীই আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সংগঠনটির কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর নানা কৌশলে দলীয় কার্যক্রম শুরু করে সংগঠনটি। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।

সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ‘গ্রিক দেবী’র ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে চলতি বছরের শুরু থেকে আন্দোলন করে আসছিল হেফাজতে ইসলাম। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১১ এপ্রিল গণভবনে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে এ ভাস্কর্যের বিষয়ে নিজের অপছন্দের কথা জানান। একই দিনে কওমি মাদরাসার দাওরা সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান ঘোষণা করেন তিনি। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।

এ নিয়ে বাম রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন মহল থেকে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিএনপি অবশ্য দাবি করেছে, ‘হেফাজত ঘনিষ্ঠতা’ সরকারের ভোটের রাজনীতির অংশ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘এটি রাজনৈতিক স্বার্থেই করেছে আওয়ামী লীগ।’

যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, ‘আমরা তো হেফাজতের সঙ্গে কোনো কমেপ্রামাইজ (আপস) করিনি। হেফাজতের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপও করতে যাইনি। আমরা বাংলাদেশের ৭০ হাজার কওমি মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের তো উপেক্ষা করতে পারি না। হেফাজত ও কওমি মাদরাসা দুটো এক জিনিস নয়।’

সরকার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বাস্তবতা বিবেচনা করে রাজনীতি করা হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক যে বাস্তবতা রয়েছে এবং জাতির যে অনুভূতি রয়েছে, তাতে আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের সেই বাস্তবতা নিয়ে এগোতে হবে।’

হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে নানা মহলের সমালোচনার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে সব দলই কৌশল অবলম্বন করে। বিজয়ী হওয়ার জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। কিন্তু আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে নয়। আওয়ামী লীগ একটি আদর্শবাদী অসাম্প্রদায়িক দল। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী কাজ করে থাকেন।’

এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা আগেই বলেছি সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবও বলেছেন যে, হেফাজতের সঙ্গে তাদের কোনো সমঝোতা চুক্তি হয়নি। মিডিয়ায় এসব বলা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আগামীকাল (শুক্রবার) শাপলা চত্বরের ঘটনার চার বছর পূর্তি হচ্ছে। ইসলাম কোনো দিবস উদযাপন সমর্থন করে না। তাই আমরা কোনো দিবস পালন করব না। তবে এদিন আমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের মানমর্যাদা রক্ষার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেদিন বর্বর আক্রমণে আমাদের অনেক ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের স্মরণে আমরা দোয়া করব। তবে এ উপলক্ষে আমাদের আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি নেই।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এম/এনআই/মে ০৪, ২০১৭)