বেওয়ারিশ লাশ ও কঙ্কাল নিয়ে চলছে কোটি টাকার বাণিজ্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও। রাজধানীর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার মেডিকেল কলেজ ও কবরস্থান কেন্দ্রিক একাধিক চক্র নিরাপদে লাশ ও কঙ্কাল নিয়ে বাণিজ্য করছে। অধিকাংশ লাশ বিক্রি হয় বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে এ সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জানা যায়, প্রতিবছর সারাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তাদের জন্য সাড়ে ৩ হাজার কঙ্কাল প্রয়োজন হয়। এ এসব কঙ্কাল বেওয়ারিশ লাশ থেকেই বানানো হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেওয়ারিশ লাশকে টার্গেট করে প্রতীক্ষার ক্ষণ গোনে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। স্বল্প ক্ষত অবস্থায় কোনো বেওয়ারিশ লাশ আনা হলে যত্নের সঙ্গে লাশটি সংরক্ষণ করা হয়। যে কোনো ব্যক্তিকে ওই লাশের ওয়ারিশ সাজিয়ে লাশটি হাসপাতালের বাইরে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে লাশটি বিক্রি করে দেওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। হাসপাতাল লাশটি চিকিৎসা শিক্ষায় ব্যবহার করে।

জানা গেছে, কবর থেকে চুরি করা একটা মানবদেহের পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালের দাম দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা। মর্গ থেকে সরাসরি বিক্রি করা হলে কঙ্কালের মূল্য দিতে হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কাটা-ছেঁড়ার জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি বেওয়ারিশ লাশ কিনতে অন্তত দেড়/দুই লাখ টাকা গুনতে হয়। কখনও কখনও লাশের সঙ্কট থাকলে মূল্য বৃদ্ধি পায়। বেশি দামে সাধারণত বেওয়ারিশ লাশগুলো অধিকাংশ সময় কিনে নেয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান জুবায়েদ আহমেদ বেওয়ারিশ লাশ ও কঙ্কাল নিয়ে বাণিজ্য সম্পর্কে বলেন, আশির দশকে মেডিকেলের শিক্ষার্থী ছিলাম। সে সময় মানবদেহের কঙ্কাল একশত টাকায় কিনেছিলাম। বর্তমানে সেই কঙ্কাল শিক্ষার্থীরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় কিনছে।

গত বছরের ২৩ আগস্ট শুক্রবার ভোরে যাত্রাবাড়ী থানার মাতুয়াইল সিটি করপোরেশনের ময়লার ডাম্পিং এলাকায় বস্তা ভর্তি কঙ্কাল পাওয়া যায়। তা একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ায় ফেলে দেওয়া হয় ময়লার ডাম্পিং এলাকায়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দু’টি মাথার খুলি, সাতটি পায়ের অংশ, বুকের পাজরসহ মানবদেহের ১৬টি টুকরো উদ্ধার করে। এ ঘটনার ৬ মাস পার হলেও পুলিশি তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই।

দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে ধানমন্ডির ৭/এ নম্বর রোডের কনটেনারটি মাতুয়াইলে আবর্জনা ডাম্পিং করেছে। সেখান থেকে উদ্ধার করা কঙ্কালগুলো ১২০২ নম্বর কনটেনারে করে আনা হয়। ধানমন্ডি এলাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ রয়েছে। ওই মেডিকেল থেকে এ কঙ্কালগুলো আনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ সূত্র জানায়, এ কঙ্কালগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্য মেডিকেল কলেজ হাসাপতাল থেকে একাধিক সময়ে সংগ্রহ করা হয়। ব্যবহারে অযোগ্য হওয়ায় কঙ্কালগুলো ফেলে দেওয়া হয়। বহুল আলোচিত ঘটনা হলেও পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না।

কঙ্কালগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ মেডিকেলের এ্যানাটমি বিভাগের প্রধান ডা. রশিদ জানান, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য কঙ্কালের প্রয়োজন হয়। আর এই কঙ্কাল সংগ্রহ করতে চাইলে বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই এই কঙ্কালগুলো বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া সরকারিভাবে এর কোনো লিখিত বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যে যেভাবে পারে কঙ্কাল সংগ্রহ করে।

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ পাওয়ার ঘটনায় তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে কঙ্কালগুলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যবহৃত হয়েছে এটা নিশ্চিত। কঙ্কালগুলোর কেমিক্যাল ও ডিএনএ পরীক্ষার পর বিস্তারিত জানা যাবে বলেও তিনি জানান।

কঙ্কাল উদ্ধার ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) কাজী জসিম উদ্দিন বলেন, মামলার তদন্ত আটকে আছে ফরেন্সিক রিপোর্টের জন্য। ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হলে রিপোর্ট হাতে পাওয়া যাবে। পরে মামলার তদন্তের অগ্রগতি হবে। তদন্তের প্রয়োজনে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছি। সংশ্লিষ্ট অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এইচএসএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪)