বিধান সরকার, বরিশাল : মন্ত্র শিখো বাপের, আর মন্ত্র শিখো সাপের। কিন্তু কি হবে, বাপ মারা গেলো ছোডকালে, মা গেল ছাইড়া। তাদের খেদমত করতে পারলাম কই। এহন এই সাপ নিয়া আছি। খেলা দেহাই, কোনো রকম জীবন কাডাই। মডার্ন বাংলাদেশ গরিবের ঠাঁই নাই। মানুষ এহন গাছগাছড়া বা সাপেরে বিশ্বাস করে না। কামাই কইমা গেছে। ঋণের লাখ টাকা শোধ করতে আর বছর খানিক সাপ খেলা দেহামু। এর পর ইস্তফা। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা। ওই সময়ের সঙ্গীদের কেউবা পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা। আক্ষেপ আছে বটে, তাই নিজেও তালিকায় ঠাঁই পাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন। লাভ  কেবল একটা, বোহেমিয়ান জীবনের শেষ ভাগটা যদিবা নিরুপদ্রব কাটানো যায় কিছুটা। এ ছাড়া আরও কত কি কথা! অকপটে স্বীকার করলেন সাপ নিয়ে নানা চালবাজির কথা মানিকগঞ্জের সাপের খেলা দেখানেওয়ালা মো. বাদশা  মিয়া (৬৩)।

দেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টোদিকে ধানমন্ডি লেকের ঘাটলায় সাপগুলো পানি খাওয়ানোর সময়। মনটা ভালো নেই, গরমে তিনটি সাপ মারা পড়েছে। বিকেল সাড়ে তিনটা হবে, ইনকাম মাত্র আড়াই শ’। নাম জিজ্ঞাসিতেই স্বভাব কবির আক্ষেপ-বাপে মায়ে নাম রেখেছিল বাদশা/চাল নাই চুলা নাই করে ডেকসোর ব্যবসা। ডেকসো বলতে বাদশা বক্সের বর্ণনায় খেলা দেখানোর জন্য সাপের বাক্স বয়ে চলা বোঝাতে চাইছেন। মানিকগঞ্জের কাটি গ্রামের খোদা বক্স ওরফে খুদু মিয়ার ছেলে বাদশা বক্স। পড়ালেখার কথা বলতে উপমায় ফিরলেন। কাটি গ্রামের পাঠশালায় শুরু করেছিলেন। তাদের শ্রেণির নাম ছিল বনভূত। তাই বাল্যশিক্ষার ছাত্ররা ব্যঙ্গ করে বলত, বনভূত খাস মুত। পণ্ডিতের কাছে নালিশ দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়ে দিলেন তোরাও বলবি, বাল্যশিক্ষা করে ভিক্ষা। আনন্দ পেতেন। সাপের মৃত্যুতে সেদিন মন খারাপ চলা সময়ে, এককথায় যেন বাল্যের আনন্দের স্বাদ পেলেন। আরও বললেন, স্যার ক্লাশে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, In which district are you dwelling? পাকিস্তানের শাসন চলমান সময়ে তার উত্তর ছিল বাংলাদেশ। পিঠ চাপড়ে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন শ্রেণিশিক্ষক। ১৯৭১ সালে ১৭ বছরের কিশোর বাদশা বক্স। মাত্র সাত বছর বয়সে মুদি দোকানি বাবা খোদা বক্সের মৃত্যু হলে মা কমলা বিবি দ্বিতীয়বার সংসার গড়েন। তাই শাসন করার কেউ ছিলেন না। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই যাত্রা দলে ভিড়ে যান বাদশা মিয়া। রূপবান, বেদের মেয়ে জোছনা, বাহারাম বাদশা, গুনাই বিবি-এসব যাত্রায় অভিনয় করে বেড়াতেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ওই সময় বড় ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে তিনি হয়ে ওঠেন তাদের সহযোগী। খবর আদান-প্রদান, নিরাপদ স্থান এবং পথ দেখিয়ে চলার কাজ করতেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাকে চেনেন, জানেন। তার বাসাতে প্রতিমাসে একবার হলেও যান বাদশা মিয়া। বঙ্গবন্ধু তার কাছে মহান নেতা। তবে দল করেন জনতার লীগ।

চলমান পেশার শুরুর কথায় বলেন, তখন রক্ষী বাহিনীর সময়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক ছিলেন বলে ভয় পেয়ে এলাকার বেদের দলে ভিড়ে ভারতে চলে যান। ওস্তাদ মঙ্গলউদ্দিন ছিলেন মস্ত বড় সাপুড়িয়া। তার কাছে শেখেন সাপ ধরার কৌশল। হিমালয় পর্বত, কালিঙ্গী পাহাড়, নীলপহাড়-এসব জায়গাতে পাওয়া যায় সাপে কাটার ওষুধ মণিরাজ বা শ্বেতবিড়াল গাছ। তবে তিনি জাত বাইদা বা সাপুড়ে নয় বলে সাপ ধরেন না। কেবল সাপের খেলা দেখান। সাভারে সাপুড়ে আছে ওদের কাছ থেকে সাপ কেনেন। দাড়াস ৯০০, কোবরা কেনেন তিন হাজার টাকায়। সাপের বিষদাঁত ভেঙে নেন। প্রতি সপ্তাহে চেক করে জমে থাকা বিষ বের করে ফেলেন। তবে বিষদাঁত ভাঙা সাপের তেজ কম থাকায় খেলা দেখানোর জন্য ত্যক্ত করতে হয়। বিন বাঁশি বাজালে সাপ আসে বা কড়ি চালান এসব সত্যি নয় জানালেন বাদশা বক্স। সাপ শুনতে পায় না। সাপ ধরতে কেবল হাতের কৌশল, চোখের নজর আর বুকের সাহস বৈ অন্য কিছু লাগে না। পেশার চলমান অবস্থার বর্ণনায় জানান, দেড় যুগ আগে বেশ ভালাই আছিলাম। দেড় দুই হাজার টাকা কামাইতাম। এই ধানমণ্ডি, আসাদ গেট, কলাবাগান, এলিফ্যান্ট রোড, আজিমপুর এসব এলাকায় ৪০ বছর ধইরা সাপ খেলা দেহাই। ডিশ লাইনে মানুষ সাপ খেলা দেখে বইলা আমার কদর নাই। এহন হাজার টাকা কামাই হয় না। তিন মাইয়া বিয়া দিছি। দুই ছেলে একটাতে গাড়ির কাজ করে, ছোটটা কম্পিউটার চালায়। এই পেশারে অরা পছন্দ করে না। বর্তমানে সাভারের পোড়াবাড়িতে ঋণ নিয়ে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছেন। প্রতি সপ্তাহে চার হাজার ২১০ টাকার কিস্তি টানতে হয়। বয়স বেড়েছে তাই ঝাকড়া চুলে বাবড়ি দোলানো পেটানো শরীরও এখন না বলে। বাদশা মিয়ার ভাষায়, ফাল্গুনের হাওয়ালের চাঁদে নাগ-নাগিনীর বিয়া দিমু এই কথা বইলা টাকা চাইতে চাইতে এহন ক্লান্ত হইয়া গেছি। নিজের পেটের বিয়াই করতে পারি না আর সাপের বিয়া। তাই এমুন কইরা ভিক্ষা চাইতে আর ভাল্লাগে না। কিস্তির টাকা শোধ করতে আর বছর খানিক লাগব। এইর পর পেশা ছাইড়া দিমু।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এনআই/জুন ১৩, ২০১৭)