আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ; এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিনিয়োগ মন্দা, রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ধস ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে বাজেটের ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ সহায়তা পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। বাস্তবতার নিরিখে এসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে বছর শেষে বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে হবে।

গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। বিশাল আকারের এ বাজেটের অর্থায়নে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অপরদিকে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ও বৈদেশিক উৎস থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা যোগান দেওয়া হবে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণের বিষয়ে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, ‘এনবিআরে সংস্কারমূলক কার্যক্রমের কারণে রাজস্ব আদায়ে গতি ফিরেছে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব প্রশাসনের অটোমেশন, কর প্রশাসন বিস্তৃতি, করের আওতা ও ভিত্তি সম্প্রসারণের কারণে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’ নতুন ভ্যাট আইন কারযকরের কারণেও রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের গতিশীলতা তৈরি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী।

তবে বৈদেশিক উৎস থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও কিভাবে তা অর্জিত হবে এ বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় কোনো কিছুই বলেননি অর্থমন্ত্রী।

এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা) তা জিডিপির ১৩ শতাংশ। জিডিপির শতকরা অংশ হিসাবে রাজস্ব আয়ের এ লক্ষ্যমাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল জিডিপির ১২.৪ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে তা সংশোধন করে ১১.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল জিডিপির ১০ শতাংশ।

অপরদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩১.৮ শতাংশ বেশি। অতীতে এতো উচ্চ প্রবৃদ্ধির রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ১৫.৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেক্ষেত্রে আগামী অর্থ বছরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৩১.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এটিকে বাস্তবসম্মত নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এনবিআরের পক্ষে তা আদায় কখনই সম্ভব হবে না। গত অর্থবছরে এনবিআরকে যে টার্গেট দেওয়া হয়েছিলো সেটাও কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এতো বড় বাজেট বাস্তবায়নে যেখানে সম্পদ আহরণে রাজস্ব বোর্ডের ওপরই নির্ভর করতে হবে সরকারকে, সেখানে এনবিআর কতোটুকু সামর্থ্য রাখে এই অর্থ সংগ্রহে সেটাও ভাবার বিষয়।’

এক লাফে লক্ষ্যমাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরো বলেন, ‘অ্যানালাইসিস করে দেখেছি বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো বছর ৩০ পারসেন্ট গ্রোথ হয় নাই। তো হঠাৎ করে আমার এমন কী বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে দেশে যে, আমি এইটা ৩০ পারসেন্টে নিয়ে যেতে পারব?’

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় অর্থনীতির দুটি মূল উৎস রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি বর্তমানে নিম্নমুখী। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’ এ অবস্থায় অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিবিড় মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ছাড়া বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ সহায়তা হিসাবে ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির আকারের তুলনায় ২.৩ শতাংশ। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৈদেশিক অর্থ সহায়তা প্রাপ্তির এ লক্ষ্যমাত্রা সর্বোচ্চ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির তুলনায় ১.৯ শতাংশ। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৫ শতাংশ। অপরদিকে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল ১৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ০.৯ শতাংশ। এ হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে যে ঋণ সহায়তা পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের দাবি, নানা কারণেই বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির পরিমাণ কমছে। উপরন্তু বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ কমে যাওয়ারই আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের কথা বাজেটে বলা হলেও বছর শেষে তার একটি বড় অংশই অর্জিত না হওয়ার আশাঙ্কা বেশি।

বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় বৈদেশিক উৎস থেকে ৪৬.২ শতাংশ বেশি অর্থায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।’ হিসাব মেলানোর জন্য ঘাটতির অবশিষ্ট হিসাবে যেটুকু বাকি ছিল তাই বৈদেশিক অর্থায়ন হিসাবে দেখোনো হয়েছে, বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘বাজেটে বিভিন্ন খাতে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এমনকি বাজেটে অর্থায়নের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জনের জন্য বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা নেই।’

বাজেটের বাকি ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে নেওয়া হবে যা জিডিপির ২.৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৬৯ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বছরশেষে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার।

রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নে যে সংশয় রয়েছে তাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি ঋণ নেওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

(দ্য রিপোর্ট/এমকে/জেডটি/জুন ১৩, ২০১৭)