বিধান সরকার, বরিশাল : সাইক্লোন নয়, তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ভারি বৃষ্টির সাথে দমকা বাতাস বয়ে যাওয়ার সময়। আবহাওয়াবিদদের অভিমত, লঞ্চের ছাদে যাত্রী বহন করলে দমকা হাওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে এসব উপেক্ষা করে ফি বছরের ন্যায় এবারো ঈদে লঞ্চ মালিকরা বাড়তি কামাইয়ের আশায়, তাদের সার্ভে সনদ অনুযায়ী ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করার তাগিদেই রয়েছেন। 

বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক বললেন, ভারসাম্য রাখতে গড়ে দেড় হাজার যাত্রী বহন করা যায়, এর বেশি হলে ঝুঁকি থাকবেই। আর জেলা প্রশাসক বললেন, তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, দুর্ঘটনা রোধে অতিরিক্ত বোঝাইয়ের আগেই লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালকের দফতর থেকে পাওয়া তথ্য হলো, বরিশাল-ঢাকা নদী পথে এমভি সুরভী নেভিগেশনের ৩টি, এমভি সুন্দরবন নেভিগেশনের ৪টি, এমভি পারাবত নেভিগেশনের ৫টি, এমভি কীর্তনখোলা নেভিগেশনের ২টি, এমভি তাসরিফ নেভিগেশনের ২টি এবং একটি করে এমভি টিপু, এমভি ফারহান, এমভি কালাম খান, এমভি দ্বীপরাজ নেভিগেশনের লঞ্চ চলাচল করে। তালিকার ২০টি লঞ্চের মধ্যে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের সার্ভে সনদ অনুযায়ী কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৪শ’ ১০ জন। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে এমভি টিপু-৭ লঞ্চে ১২শ’ ৮০ যাত্রী বহনে সক্ষম। তৃতীয় অবস্থানে থাকা এমভি সুরভী-৯ যাত্রী ধারণক্ষমতা ১২শ’ ৭৪ জন। চতুর্থ অবস্থানের এমভি দ্বীপরাজ লঞ্চের ধারণ ক্ষমতা ১১শ’ ৪১ যাত্রীর। পঞ্চম অবস্থানের এমভি পারাবত-১১ লঞ্চে ১ হাজার ২৫ যাত্রী আর ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা সুন্দরবন নেভিগেশনের এমভি সুন্দরবন-৮ লঞ্চে যাত্রী বহন করার অনুমতি রয়েছে ১ হাজার ২০ জন। অপর লঞ্চগুলো যাত্রী ধারণ ক্ষমতা উল্লেখ আছে হাজারের নিচ থেকে ৬শ’ ৩৯ জন পর্যন্ত। তবে বিলাসবহুল লঞ্চগুলোয় গেল ঈদে ঢাকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৭ হাজার যাত্রী বহন করা হয়েছিল। লঞ্চের টিকিট ক্লার্ক ও বেকিন বয়দের কাছ থেকে এ তথ্য পেলেও লঞ্চ মালিক বা নৌ-নিরাপত্তার সাথে যুক্ত কোন কর্মকর্তা বাড়তি যাত্রী নেওয়ার কথা জানালেও, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৫গুণ বেশি যাত্রী নেওয়ার কথা কখনোই স্বীকার করেন না।

এই দফতর থেকে আরও পাওয়া তথ্য হলো, এ বছর ঈদে ঢাকা বরিশাল রুটে ভায়া ও দিবা সার্ভিস মিলিয়ে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করবে। ঘরে ফেরার জন্য ঢাকা থেকে ২২ তারিখ স্পেশাল যাত্রা শুরু হয়ে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত চলবে। স্পেশাল যাত্রায় থাকা ১৫টি লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে ডবল সার্ভিসে অংশ নেবে। একইভাবে ২৮ তারিখ থেকে বরিশাল নদীবন্দর থেকে রাজধানীগামী লঞ্চের স্পেশাল সার্ভিস শুরু হয়ে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। এই সেবার পরিধি যাত্রী সংখ্যার ওপর নির্ভর করবে বলে জানালেন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর রিয়াদ হোসেন।

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক প্রণব কুমার রায় বলেন, মার্চ থেকে মে আগাম মৌসুমের সময়। এসময় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থাকে। আর অক্টোবর থেকে নভেম্বর হলো মৌসুমপরবর্তী সময়। তাদের হিসেবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি সময় হলো বর্ষা মৌসুমের। এসময় বৃষ্টির সাথে দমকা বাতাস বয়ে চলে। আর নদী বন্দরগুলোর জন্য সব সময়ই এক নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল থাকে। আবহাওয়ার অবনতি হলে সংকেত বাড়ানো হয়। দমকা বাতাসের কারণে লঞ্চে ছাদে যাত্রী বহন করলে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।

এনিয়ে কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, এবার আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়াতে ছাদে মোটেই যাত্রী বহন করা যাবে না বলে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ছুটি লম্বা হওয়াতে ঈদের যাত্রীরা আসতে যেতে সময় পাচ্ছেন বলে চাপ কম থাকবে। তাদের লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা সার্ভেতে এক হাজার ২০ জন উল্লেখ থাকলেও ২০ থেকে ২৫ টন মাল বহন করারও অনুমতি আছে। সেক্ষেত্র ঈদের যাত্রায় তারা মালামাল গুরুত্বপূর্ণ না হলে বহন করেন না। এতে করে বাড়তি যাত্রী ওঠানো হলেও লঞ্চের বিপদসীমা অতিক্রম করে না কখনোই।

বরিশাল নদী বন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হুদা মিঠু বলেন, তাদের সার্ভে অনুযায়ী গড়ে দেড় হাজার যাত্রী লঞ্চে যাওয়া-আসা করবে। তাতে করে বরিশাল নদী বন্দর থেকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ যাত্রী হবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে লঞ্চে মালামাল পরিবহন তেমন হয় না বলে ভারসাম্য বজায় রাখতে কিছুটা বাড়তি যাত্রী হলে সমস্যা হবে না। তবে তারা নজর রাখবেন যাতে করে ছাদে যাত্রী পরিবহন না করে। তাহলে দমকা হাওয়ায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকবে। সহজ কথায় যাত্রী নিরাপত্তায় ও দুর্ঘটনা এড়াতে লঞ্চে দক্ষ মাস্টার, সুকানী থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় যন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা এসবের প্রতি কঠোর নজর রাখবেন তারা।

জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এবারো যাত্রীসেবায় তার দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট নিয়মিত দায়িত্ব পালন করবেন। গেল বছরও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের আগেই পন্টুন ছেড়ে দেওয়াতে লঞ্চমালিকদের সাথে বচসা পর্যন্ত হয়েছে। এবার রাফ আবহাওয়ার কথা বিচেনা করেই যাত্রী নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় লঞ্চ কিছুতেই নদী বন্দর ছেড়ে যেতে দেওয়া হবে না।

(দ্য রিপোর্ট/এপি/এনআই/জুন ১৯, ২০১৭)