আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বখ্যাত নিরাপত্তাবিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক আইএইচএস জেনস গ্লোবাল টেরোরিজম অ্যান্ড ইমারজেন্সি অ্যাটাক ইনডেক্স-২০১৩। সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশের পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে কাজে লাগাতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে এতদিন অবস্থান নিয়ে তাদেরই ছাত্র সংগঠন শিবিরিকে বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি সংস্থা। এটা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একজন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করে তাকে ধরার অজুহাতে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর যে নতুন কৌশল নিয়েছে আমেরিকা বাংলাদেশও সেই কৌশলে আটকে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সংশয় তৈরি হয়েছে। যেভাবে আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের মাধ্যমে মোল্লা ওমরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীকালে মোল্লা ওমরকে উচ্ছেদ করতেই আফগানিস্তান দখল করে নেয়। ইরাক দখলের ইতিহাসও প্রায় একই। ছাত্রশিবিরের পাশাপাশি সরকারকেও এই ফাঁদে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

বিশ্বে সামরিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে আইএইচএস জেনস একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। ২০১৩ সালে সারাবিশ্বে সংঘটিত জঙ্গি ও অজঙ্গি সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী ঘটনা এবং সহিংসতার পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা প্রণয়ন করেছে জেনস।

এই তালিকা প্রকাশের পর এখন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। এ ছাড়া ছাত্রশিবিরকে যদি নিষিদ্ধ করা হয়, সেক্ষেত্রে তারা আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। সেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা রিপোর্ট করল যে, শিবির বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ থাকতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কৌশল হিসেবে তারা এটা করতে পারে।

এ ছাড়া বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ‘মোস্টমডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে। তাই তাদের কোনো উদ্দেশ্য থাকতেই পারে।

ছাত্রশিবির প্রসঙ্গে জেনস বলছে, বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে সংগঠনটি। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হওয়ার পর থেকেই তারা ব্যাপকভাবে সহিংস হয়ে ওঠে। যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণা এবং কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই তাদের হামলার শিকার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষ। গত এক বছরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সহিংস সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ।

সংস্থাটি বলছে, ছাত্রশিবির পুলিশের গাড়িতে আগুন জ্বালিয়েছে, পুলিশের মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে, গায়ে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করেছে।

সংস্থাটি শিবির প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলেছে, ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গেও ছিল এই শিবিরের সম্পর্ক। সে সময় সংগঠনটি ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে।

এদিকে, গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকার একই অভিযোগ করে আসছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য তারা হুমকিস্বরূপ বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন শিবির একটি জঙ্গি সংগঠন। তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন।

প্রধানমন্ত্রী বারবার শিবিরকে সহিংস সংগঠন বললেও নিষিদ্ধ করতে উদ্যোগী হননি। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই সংস্থাটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবিরকে চিহ্নিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও বলে আসছে, শিবির রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত। তারা রাজপথে বোমাবাজি, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে তারা তাদের প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব চালায়। গত বছরের শেষদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কমান্ডো স্টাইলেও তাণ্ডব চালিয়েছে বলে তারা রিপোর্ট দিয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। রিপোর্টে থাইল্যান্ডের বারিসানরে ভুলুসি ন্যাশনাল ও আফগানিস্তানের তালেবানের পরপরই রয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নাম।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বারবার জঙ্গি সংগঠন বলে যে জুজু ছড়িয়েছে, তাতে অন্যরা এর সুযোগটা নিতে পারে। আর বাংলাদেশকে একটি মডারেট ইসলামী কান্ট্রি হিসেবেই মনে করে আমেরিকা। তাই তাদের কোনো উদ্দেশ্য তো থাকতেই পারে। তবে এ নিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলে মনে করি। কেননা বিষয়গুলোকে আমি সাজানো ঘটনা বলেই মনে করি।’

আন্তর্জাতিক সংস্থাটির রিপোর্ট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমেরিকার একটি সংস্থা এমন অভিযোগ করেছে, এতে আমি আশ্চর্য হয়েছি। কারণ আমেরিকার কারণেই এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করতে পারছে না সরকার। তবে সরকার যদি এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তাদের নিষিদ্ধ করে, তবে তারা ভিন্ন নামে আবার মাঠে নামবে।’

তিনি আরও বলেন, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এই রিপোর্ট দিয়েছে। এর অর্থ এটি একটি আন্তর্জাতিক খবর। তাই বাইরে থেকে তো অবশ্যই চাপ আসবে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা তো অনেক দিন ধরেই বলে আসছি শিবির সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এবার আমাদের কাজটা সহজ হয়ে গেছে। এখন আমরা আইনি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি।’

ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে এই রিপোর্টকে সাজানো বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগসূত্র আছে বলেও তারা মনে করছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি (দক্ষিণ) জহির উদ্দিন বলেন, আমরা এটাকে সম্পূর্ণ সরকারের ষড়যন্ত্র হিসেবে মনে করছি। কেননা আমাদের নিষিদ্ধ করতে সরকার এটি পরিকল্পিতভাবে করেছে। আমাদের সংগঠনের কেউই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নয়।

(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এইচএসএম/এনআই/এসবি/এজেড/ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৪)