সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত/উদ্বৃত্ত জমি লিজ প্রদানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বেসরকারিকরণ কমিশন (প্রাইভেটাইজেশন কমিশন)। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই কমিশন কাজ শুরু করবে।

উল্লেখ্য, বেসরকারিকরণে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর ২০১০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমি লিজ প্রদানের বিষয়ে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায় কমিশন। একই সঙ্গে কমিশনের উদ্যোগে ৩৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমির ওপর একটি সমীক্ষাও চালানো হয়। কমিশনের তদানীন্তন চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন যে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ব নীতিগত সম্মতি রয়েছে। কিন্তু উদ্বৃত্ত জমির বিষয়ে তথ্য প্রদানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর (শিল্প, পাট ও বস্ত্র, বাণিজ্য) অসহযোগিতা এবং লিজ প্রদানে আপত্তির কারণে কমিশনের এ উদ্যোগও ঝিমিয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমি চিহ্নিতকরণ ও এগুলোর বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর সেই সময়কার অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। শেষের দিকে এ কমিটির সভাপতি করা হয় বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. এস এ সামাদকে। গঠিত ওই কমিটি একটি লিজ ডকুমেন্ট তৈরি করার পাশাপাশি একটি সাব-কমিটির আওতায় ৩৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমির পরিমাণ চিহ্নিত করে। গত বছরের ৮ জুলাই কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে এবং এটি অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠায়।

এ ব্যাপারে সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারিকরণ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। গত মহাজোট সরকারের আমলের শেষ দিকে টাস্কফোর্সের সুপারিশসমূহ অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠনো হয়েছিল এবং কমিটি সেগুলো পর্যালোচনা করেছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৫ দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে এবং সর্বশেষ গত ৪-৫দিন আগে আরেক দফা সুপারিশ পাঠানো হয়। কিন্তু এখনো এগুলোর বিষয়ে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।’

একই প্রসঙ্গে কমিশনের সাবেক পরিচালক (শিল্প) সৈয়দ জগলুল পাশা বলেন, ‘বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রথম দফায় ৩৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে। আগামীতে আরও ৮০ থেকে ৮৫টি প্রতিষ্ঠানের ওপর সমীক্ষা চালানো হবে।’

চিহ্নিত এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য প্রদান কিংবা এগুলোর অব্যবহৃত জমি লিজ প্রদানে মন্ত্রণালয়গুলোর অসহযোগিতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে বাস্তবতার দিক থেকে যখন কোনোকিছু পর্যালোচনা করা হয়, তখন প্রতিরোধ প্রবল হয় না।’

প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিটি পাট, বস্ত্র ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেশের ৬টি বিভাগের ২১টি জেলার ৩৮টি প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে প্ররিদর্শন করেছে। এর মধ্যে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিটিএমসির ১৪টি, পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিজেএমসির একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনিশিল্প কর্পোরেশনের ১০টি, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের ৪টি ও বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে টেকেরহাট মাইনিং কোম্পানিটি পরিদর্শন করতে পারেনি কমিটি।

কমিটির হিসাবমতে, ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মোট জমির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৪৯ একর। এর মধ্যে উদ্বৃত্ত/অব্যবহৃত জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৫১৬ দশমিক ৭৪ একর। টেকেরহাট মাইনিং কোম্পানির উদ্বৃত্ত/অব্যবহৃত জমি হিসাবে ধরলে এটা ১ হাজার ৭০০ একর ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বেসরকারিকরণ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিলের মতে, ‘শিল্পায়নের জন্য দেশে জমির চাহিদা রয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা জমির অভাবে কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপন করছেন। ফলে কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। এ উদ্যোগটি নেওয়া হলে কৃষিজমি রক্ষা পাবে, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। আগ্রহী উদ্যোক্তাদের ৫ একর করে জমি লিজ দেওয়া হলে প্রায় তিনশতাধিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। পাশাপাশি একরপ্রতি এককালীন লিজিং মানি ১ কোটি টাকা ধরলে রাজস্ব খাতে ১ হাজার ৫১৬ কোটি আয় হবে সরকারের।’

এদিকে, উদ্বৃত্ত/অব্যবহৃত জমি লিজ প্রদানের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে বিটিএমসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়।

এ ব্যাপারে বিটিএমসির পরিচালক (পরিচালন) ও গঠিত সাব-কমিটির সদস্য মো. আবদুর রাজ্জাক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘১৪টি কারখানার মধ্যে চারটি সার্ভিসচার্জ পার্টির মাধ্যমে চালু রয়েছে ও পাঁচটি বন্ধ রয়েছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের জমিতে একাধিক বস্ত্রপল্লী স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ কারখানাগুলো চালু হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য আবাসন, খেলার মাঠ, ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিনোদন ক্লাব, ফলের বাগান ও জলাশয়/পুকুরসহ প্রাচীরবেষ্টিত সমুদয় জমিই এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে। কোনো উদ্বৃত্ত জমি থাকবে না।’

এ ছাড়া চিঠিতে বিটিএমসিকে শক্তিশালী করে পিপিপি, বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্রকলগুলো টিকিয়ে রাখার প্রস্তাব করেন তিনি।

অন্যদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ২৩টি প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত/অব্যবহৃত জমি লিজ দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়াধীন শিল্প স্থাপনে পরবর্তী সময়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে বলে চিঠিতে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সানোয়ার হোসেন।

চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮টি বন্ধ, ১৮টি চালু ও তিনটি আংশিক চালু রয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই বিপুল পরিমাণ দায়-দেনা রয়েছে এবং প্রতিবছরই তা বাড়ছে। গত ২০১২ সাল পর্যন্ত এগুলোর মোট দায়-দেনার পরিমাণ হচ্ছে ৫ হাজার ১৯০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

যে ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত/উদ্বৃত্ত জমি চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো- দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস, চিত্তরঞ্জন কটন মিলস (নারায়ণগঞ্জ), কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস (টঙ্গী), রাজশাহী টেক্সটাইল মিলস, আমিন টেক্সটাইল মিলস (চট্টগ্রাম), ভালিকা উলেন মিলস (চট্টগ্রাম), দি ন্যাশনাল কটন মিলস (চট্টগ্রাম), আর আর টেক্সটাইল মিলস (চট্টগ্রাম), সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস (সাতক্ষীরা), বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলস (যশোর), কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলস (কুড়িগ্রাম), দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলস (নীলফামারী), খুলনা টেক্সটাইল মিলস (খুলনা), দোস্ত টেক্সটাইল (ফেনী), ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানা (ঠাকুরগাঁও), রাজশাহী জুট মিলস (রাজশাহী), ঢাকা লেদার কোম্পানি (সাভার, ঢাকা), উসমানিয়া গ্লাস সিট (চট্টগ্রাম), খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস (খুলনা), কর্ণফুলী পেপার মিলস (রাঙ্গামাটি), কর্ণফুলী রেয়ন অ্যান্ড কেমিক্যালস (রাঙ্গামাটি), চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স (চট্টগ্রাম), ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি (সুনামগঞ্জ), বাংলাদেশ ইন্স্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ফ্যাক্টরি (মিরপুর, ঢাকা), ন্যাশনাল টিউবস (টঙ্গী, গাজীপুর), চট্টগ্রাম ড্রাই ডক (চট্টগ্রাম), ইস্টার্ন ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রিজ (পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম), প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ (চট্টগ্রাম), সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস (দিনাজপুর), পাবনা সুগার মিলস (পাবনা), মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস (ঝিনাইদহ), কেরু অ্যান্ড কোং (চুয়াডাঙ্গা), কুষ্টিয়া সুগার মিল (কুষ্টিয়া), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল (গোপালপুর, নাটোর), রাজশাহী সুগার মিল (রাজশাহী), নাটোর সুগার মিল (নাটোর), রংপুর সুগার মিল (গাইবান্ধা), জয়পুরহাট সুগার মিল (জয়পুরহাট)।

(দ্য রিপোর্ট/এস আর/এইচএসএম/এজেড/ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৪)