পঞ্চগড় প্রতিনিধি : ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত এই কবিতার ঠিক উল্টোটাই এখন পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে।

এখন আর শুধু বৈশাখ নয়, প্রায় বারো মাসই পঞ্চগড়ের প্রধান নদী করতোয়ায় হাঁটুজল থাকে। এমনকি ভরা বর্ষার মধ্য শ্রাবণেও করতোয়ার বুকে দেখা যাচ্ছে শুকনো বালুচর। এমন দৃশ্য শুধু স্রোতস্বিনী করতোয়ায় নয়, পঞ্চগড়ের বুকে বয়ে যাওয়া ছোট-বড় ৩৩টি নদীর প্রায় সবই এখন শুকনো।

সম্প্রতি দেশের অন্যত্র বন্যা হলেও সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের নদীগুলো শুকনোই রয়ে গেছে। ষড়ঋতুর দেশে ভরা বর্ষাকালে জেলার করতোয়াসহ ছোট বড় নদীগুলোর দু’কূলে জলের স্পর্শ লাগেনি। নদীর বুকে মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে বালুচর। গত এক দশকে করতোয়া নদীতে উল্লেখযোগ্য হারে পানি হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে।

জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোর উজানে ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বর্ষাকালেও করতোয়ায় পানি নেই বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

একটা সময় ছিলো যখন এলাকার মানুষের কাছে করতোয়া প্রবল খরস্রোতা নদী হিসেবে পরিচিত ছিলো। মহাভারতে এই নদীকে প্রবল খরস্রোতা ও পবিত্র নদী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পঞ্চগড় জেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই করতোয়া নদীকে ঘিরেই। বর্ষার আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আর পানির তোড়ে করতোয়ার ভাঙ্গনের শব্দে ঘুম ভাঙতো নদীর তীরবর্তী মানুষের। বণিকদের বড় বড় জাহাজ চলতো এই নদী দিয়ে। কিন্তু কালের বির্বতনে আর উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে করতোয়া নদী আজ প্রাণ হারাতে বসেছে।

স্রোতস্বিনী করতোয়া এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এখন বর্ষাকালেও করতোয়া আগের মতো আর দু’কূল প্লাবিত করে বয়ে চলে না। নেই আগের মতো জৌলুস। হাঁটু পানির নিচে চিকচিক করা বালি দেখা যায়।

শুধু করতোয়া নয় পঞ্চগড় জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা চাওয়াই, মহানন্দা, ডাহুক, বেরং, টাঙ্গন, তালমা, পাঙ্গা, পাম, ভেরসা, আত্রাই, গোবরা, তীরনই, রণচণ্ডী, ছেতনাই, পেটকি, ঘোড়ামারা, মরা তিস্তা, নাগর, খড়খড়িয়া, সুই, ছোট যমুনা, পাথরাজ, ভুল্লি, কুড়ুমসহ ছোট বড় ৩৩টি নদীর অবস্থা একই রকম। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এসব নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের হিমালয় ও সিকিমের পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সেখান থেকে উৎপত্তি হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু অভিন্ন এই নদীগুলোর উজানে ভারত একাধিক বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার আর নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলোর এই নাজুক অবস্থায় এসেছে।

নদীগুলোর অধিকাংশই মানচিত্র থেকে বিদায় নেওয়ার পথে। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে কৃষি, মাছ, জলজ উদ্ভিদসহ প্রাণীকূলেও। হুমকিতে পড়েছে নদী কেন্দ্রিক কৃষকদের সেচ ব্যবস্থা। জেলায় দেখা দিয়েছে দেশী মাছের সংকট। জীবিকা নির্বাহ নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন জেলেরাও।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার আমতলা এলাকার করতোয়া পাড়ের বাসিন্দা কোরবান আলী সবুজ বলেন, ‘আষাঢ় মাস শেষ হয়ে শ্রাবণের প্রায় অর্ধেক চলে গেছে তারপরও আমাদের করতোয়ায় পানি নেই। এই বর্ষকালেও মানুষ হেঁটেই নদী পার হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আমন আবাদ তো করতেই পারবোনা’

দেবীগঞ্জ উপজেলার করতোয়া পাড়ের বাসিন্দা মজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় শ্রাবণে করতোয়ার একূল-ওকূল দেখা যেতো না। আমরা ছোট বেলায় সাঁতরিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন দেখেন শুধু বালি আর বালি। পানির কোন অস্তিত্বই নেই। আগের দিনগুলো মনে পড়লে এখনকার করতোয়া দেখে খুব দু:খ হয়।’

পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু জানিয়েছেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আর ভারত থেকে আসা অভিন্ন নদীগুলোতে একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করায় পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমে গেছে। এবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নদীর পানি আরও কমে গেছে। এছাড়া নদীগুলো নাব্য হারালেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ইতোমধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহল ঘেঁষা করতোয়া নদীর ৫ কি.মি খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ বছর আরও ৭৭ কি.মি. খননের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য নদীগুলো খননের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হবে। তবে এ বছর পঞ্চগড় জেলায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএনইউ/এনআই/জুলাই ২৯, ২০১৭)