দিনাজপুর প্রতিনিধি : দিনাজপুরে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও যথাযোগ্য মর্যাদা, পূজার্চনা ও ধর্মীয়-ভাবগাম্ভির্যের মধ্যদিয়ে শেষ হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৩ দিনব্যাপী ৪৪তম মহাত্রিপুরারী কৈলাশপতির মহাস্নানযাত্রা উৎসব। সোমবার (৭ আগস্ট) ছিল এ উৎসবের শেষদিন।

আয়োজকরা জানান, মূলত দেশ ও দেশের শান্তি কামনা ও শিব ঠাকুরকে রাজি-খুশি করতে প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে ঝুলন যাত্রা থেকে রাখি পূর্ণিমার মাঝে সোমবার তিথিতে এই কৈলাশপতির মহাস্নানযাত্রা উৎসব পালন করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, গত ৫ আগস্ট শনিবার রাতে হাজার হাজার ভক্ত-পুণ্যার্থী বাসযোগে দিনাজপুর শহর হতে ৩৪ মাইল দূরে বীরগঞ্জ উপজেলার মহুয়াগাঁও শ্মশান ঘাট মন্দির সংলগ্ন পুনর্ভবা নদীর উত্তরমুখে প্রবাহিত জল সংগ্রহ করতে যায়। সেখানে রাতব্যাপী কীর্ত্তন চলে। পরদিন ৬ আগস্ট রবিবার যখন পূর্ব আকাশে সূর্য দেখা যায় ঠিক তখনই সেই উত্তরমুখে প্রবাহিত জল সংগ্রহ করতে নদীতে নেমে পড়েন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। সূর্য দেবতাকে প্রণাম করে সেই জল সংগ্রহ করে সেখানে অবস্থিত শিব মন্দিরে জল ঢেলে পুনরায় একই নিয়মে জল সংগ্রহ করে সেখানকার পুরোহিত দ্বারা সেই জল পবিত্র করে শহরের আনন্দ সাগরস্থ শ্রী শ্রী গোষ্ঠধাম প্রাঙ্গণে শিব মন্দিরের উদ্দেশে নগ্ন পায়ে যাত্রা শুরু করেন।

সেখানকার পুরোহিত মাখনলাল চক্রবর্তী ও প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তী জানান, প্রতি বছর এই মহুয়া নদীতে হাজার হাজার ভক্ত-পুণ্যার্থী পুণ্যজল সংগ্রহ করতে আসেন।

পরে ৩৪ মাইল রাস্তা নগ্ন পায়ে হেঁটে শহরের চকবাজারস্থ শিতলা মন্দিরে পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। এর মাঝে রাস্তায় তিন স্থানে বিরতির নিয়ম আছে। সেখানে ‘বলে বোম কমিটি’র পক্ষ থেকে প্রসাদ, চিড়া ও খিচুরি দেয়া হয় ভক্ত-পুণ্যার্থীদের। পরদিন ৭ আগস্ট সোমবার দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেট এর অধীন শহরের আনন্দ সাগরস্থ শ্রী শ্রী গোষ্ঠধাম প্রাঙ্গণে শিব মন্দিরে সেই সংগ্রহকৃত পূণ্যজল শিব ঠাকুরের মাথায় ঢেলে এই মহাস্নানযাত্রা উৎসব সম্পন্ন করেন ভক্ত ও পুণ্যার্থীরা।

অপরদিকে একই নিয়মে আনন্দ সাগর হতে সাত মাইল পূর্বে অবস্থিত কাঁউগাঁও-সাহেবগঞ্জ হাটসংলগ্ন আত্রাই নদীর উত্তরমুখে প্রবাহিত পুণ্যজল সংগ্রহ করেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভক্তবৃন্দ। সেখানে থেকে পুণ্যজল সংগ্রহ করে নগ্ন পায়ে আনন্দ সাগর গোষ্ঠধাম শিব মন্দিরে যান ভক্তরা।

দুই দিক থেকে পুণ্যজল সংগ্রহ করার পর ভক্ত-পুণ্যার্থীরা রাতে আনন্দ সাগর শ্রী শ্রী গোষ্ঠ ধামে অবস্থান করেন এবং রাতব্যাপী কীর্ত্তন করেন ও শোনেন। পরে ভোর ৪টায় প্রথমে কমিটির পক্ষ থেকে শিব মন্দিরে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢেলে পূজা-অর্চনা করা হয়। পরে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢালা শুরু করেন হাজার হাজার ভক্ত-পুণ্যার্থী। পরে সকালে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয় কমিটির পক্ষ থেকে।

‘বলে বোম কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক অশোক আগরওয়ালা জানান, দিনাজপুরে ১৯৭৪ সালে এই মহাস্নানযাত্রা উৎসব শুরু হয়। পরে প্রতি বছর এই উৎসব পালন করা হয়। এটিই বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ কৈলাশপতির মহাস্নানযাত্রা। আর যে কোন মনোবাসনা নিয়ে কেউ যদি মন থেকে এই শিব ঠাকুরের পূজা করে তবে ঠাকুর সেটি পূর্ণ করেন- সেই বিশ্বাস থকে প্রতি বছর আমরা মহাত্রিপুরারী কৈলাশপতির মহাস্নানযাত্রা পূজা করে আসছি।

কমিটির সদস্য সন্তোষ আগরওয়ালা বলেন, আমরা এই পূজা পরিচালনা করছি ৪৪ বছর ধরে। প্রথম ১১ জন থেকে শুরু করে আজ লক্ষাধিক ভক্ত-পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে।

কথা হয় এ বছর ৪৪তম মহাত্রিপুরারী কৈলাশপতির মহাস্নানযাত্রা উৎসবে রবিবার সকালে মহুয়া গ্রামে পুণ্যজল সংগ্রহ করতে আসা শহরের রাধে শ্যাম, চুনিয়াপাড়ার পুতুল রানী বালা ও পূজা বালা এবং সোমবার আনন্দসাগর গোষ্ঠধাম মন্দিরে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে আসা চকবাজারের মিতনি ঘোষ ও শিক্ষার্থী জ্যোতির সাথে। তারা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আমরা মূলত পুণ্য করতে ও দেশ ও দশ যাতে ভালো থাকে সেজন্য এই পূজা করি। কারণ দেশের সবাই যদি ভালো থাকে তবে আমিও ভালো থাকবো। আবার কেউ এই পূজা করেন যাতে তার মনোবাসনা পূরণ হয়, লেখাপড়ায় ভালো করতে পারেন সে জন্য। কেউ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেন এই পূজা বা তীর্থ করার জন্য। কারণ এই পূজার মাধ্যমে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢাললে স্বামীর আশির্বাদ পাওয়া যায় এবং স্বামীর মঙ্গল হয়।

(দ্য রিপোর্ট/এজে/এনআই/আগস্ট ০৭, ২০১৭)