আমি আমার সেই মহানায়কদের কাতারে এসে দাঁড়ালাম

 

 

[৫ অক্টবর ২০১৭। বেলা না গড়াতেই এবছরের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি। তারপরই নোবেল বিজেতা জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক কাজুও ইশিগুরোর দোর অবধি জনতার ঢল বাড়তে থাকে। তখন পর্যন্ত কাজুও ইশিগুরো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না ঘটনার সত্য-মিথ্যা। বেলা গড়ালে অ্যাডাম স্মিথ, নোবেল মিডিয়ার চিফ সাইন্টিফিক অফিসারের সাথে মুঠোফোনে কথা বলেন কাজুও। তাদের কথপোকথন অনুবাদ করে পত্রস্থ করা হলো। বি.স]

 

 

কাজুও ইশিগুরো:    হায়, হ্যালো, মি. স্মিথ, কেমন আছেন?

অ্যাডাম স্মিথ:     খুব ভালো। অনেক ধন্যবাদ, কল করেছেন, খু্বই ভালো। নোবেল জয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।

কাজুও ইশিগুরো:    হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আসলে দুঃখিত আপনার ফোন ধরতে পারিনি। এখানে আসলে হৈচৈ হুলুস্থূল কাণ্ড, কী বলব চমকে উঠেছি। হঠাৎই... প্রচুর সাংবাদিক এসে জড় হয়েছে, রাস্তায় তাদের লম্বা লাইন।

অ্যাডাম স্মিথ:     বুঝতে পারছি আমিও। তাহলে তো আপনার দিনের শুরুটাই পুরোদস্তুর অপ্রত্যাশিতভাবে। আপনি কীভাবে সংবাদটি (নোবেল প্রাপ্তির) পেলেন?

 

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ, কিচেনে বসে এক বন্ধুকে একটা মেইল করছিলাম আর এমন সময় ফোন বেজে উঠল। আর অনবরত বেজেই যাচ্ছিল। আমার সাহিত্য সঙ্ঘ-সহচরেরা লাইভফিডে ঘোষণার সরাসরি অনুষ্ঠানে চোখ রাখছিল। আমার মনে হয় না তারা এটা প্রত্যাশা করেছিল; তবে কে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছে এ বছর তা শোনার জন্যই কেবল তারা অপেক্ষা করছিল। আর তাই আমি একের পর এক কল রিসিভ করেই যাচ্ছিলাম আর এটা বারবার বলছিলাম এটা নিশ্চয় ধাপ্পাবাজি, নয়তো ভূয়া সংবাদ হবে, তাছাড়া আর কি! কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যাপারটার সত্যতা নিশ্চিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে যখন বিবিসি আমাকে কল করলো তখন আমি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলাম। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি আসলে থামিনি। ব্যাপারটা কিছুটা মেরি সিলাস্টের মতো- কেউ ছিল না যেখানে সহসা সেখানে হৈচৈয়ের কাণ্ডটা শুরু হল বেলা ১১টা নাগাদ। এখন রাস্তায় জনতার সারি আমার ইন্টারভিউ নিতে।

অ্যাডাম স্মিথ: তো এখন কি কিছুটা হৈচৈ থামল?

কাজুও ইশিগুরো: নাহ্! না, মনে হয় যে লম্বা সময় লাগবে। আসলে আমি বলছিলাম, এটা যে অদ্ভুত এক বড় মাপের সম্মান, এমন সব বিষয়ে যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। আমার মনে হয় না নোবেল পুরস্কারের চে’ বড় সম্মানের পুরস্কার আপনি পাবেন। আমি যেটা বলতে পারি, মানে, একটা বিষয় যে, সুইডিশ একাডেমি সমস্ত রাজনৈতিক ধস্তাধস্তি আর বচসার ঊর্ধ্বে উঠে, মনে করি এটা সফলভাবে সম্পাদন করেছে- এটাই বড় কথা, এটাই সম্মানের। আমার ধারনা, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে যার বিশুদ্ধতা সম্মানের সাথে গৃহিত হয় তেমন অল্পসংখ্যক মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ের সাথে এটিও বিবেচিত হবে। আর তাই আমি মনে করি সুইডিশ একাডেমির এই প্রকৃত অবস্থানই এই পুরস্কার গ্রহণের সে মর্যাদাবোধের কারণ। এও মনে করি, সুইডিশ একাডেমি যে এই বিরাট অর্জন আজ অবধি সেই উচ্চতায় ধরে রাখতে পেরেছে জীবনের নানান চরাচরে সেটাই সম্মানের। উপর্যুপরি এ বিষয়টা আমার জন্য ভয়ঙ্কর সম্মানের কারণ- মানে বুঝতেই পারছেন, আমি আমার সেই মহানায়কদের কাতারে এসে দাঁড়ালাম যারা আসলেই মহোত্তম লেখক। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ লেখকরা এই পুরস্কার পেয়েছেন। আমি বলব কি জানেন, বব ডেলান যে কিনা আমার কাছে হিরো, সেই ১৩ বছর বয়স থেকেই, তাঁর এক বছর পর আমার এই প্রাপ্তি সত্যিই বিশাল। তিনি সম্ভবত আমার কাছে সবচে’ বড় হিরো।

অ্যাডাম স্মিথ: তাহলে তো বেশ সোনায় সোহাগা হয়ে গেল।

কাজুও ইশিগুরো: তা তো বটে। আমি খুব ভাল করে বব ডেলানের রূপ ধরতে পারি, তবে এখন করতে পারবো না, হে... হে...।

অ্যাডাম স্মিথ: আপনার দয়া, নিশ্চয় আমার তা ভাল লাগতো। অন্তত যদি ডিসেম্বরে স্টকহোমে আসেন দয়া করে।

কাজুও ইশিগুরো: হে... হে... হ্যাঁ, সেটা চেষ্টা করতে পারি।

অ্যাডাম স্মিথ: অবশ্যই। ব্রিটেনে এখন মজার সময় যাচ্ছে। তবে জায়গাটা কি আপনার পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন কোন বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে?

কাজুও ইশিগুরো: আমি মনে করি, করছে। আসলে আপনাকে ফোন দেবার ঠিক আগেই আমি একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির জন্য একটা স্টেটমেন্ট মতো লিখছিলাম, আর আমি ভাববার চেষ্টা করছিলাম তিন লাইনের মধ্যে কী বলা যায়। আর আমি মনে করি সময়টা আমার জন্য প্রাসঙ্গিক কেননা আমি বোধ করি... আমার বয়স ৬৩ হতে চলল, আমার মনে পড়ে না আমরা কখনও এতটা অনিশ্চিত ছিলাম পশ্চিম বিশ্বে আমাদের মূল্যবোধ নিয়ে। কি জানেন, মনে হচ্ছে, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের নেতৃত্বের একটা বিরাট অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মানুষ নিরাপদ বোধ করে না। তাই আমার মনে হয় নোবেল পুরস্কারের মতো একটা বিষয় সারা বিশ্বে কোনভাবে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সমুচিত মূল্যবোধে। আর এটাই পরিমিত আর এর নিরবচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। হুম।

অ্যাডাম স্মিথ: আমার ধারণা, আপনার এই সময়ের যত লেখা, তা কোনভাবে বিশ্বে আমাদের অবস্থানের প্রশ্নের; অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক, বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে। সম্ভবত এই থিমটিই আপনি বেশি উন্মোচন করেছেন, আপনার কি ভাবনা?

কাজুও ইশিগুরো: হুম, তা বটে, আমি তা-ই ভাবি... যদি ছোট্ট করেও বলি, সম্ভবত আমাকে যে বিষয়গুলো সবসময় আকৃষ্ট করে তার একটা হল কিভাবে আমরা একই সাথে ক্ষুদ্র বিশ্বে ও বৃহৎ বিশ্বে বাস করছি আর আমাদের একটি ব্যক্তিগত পরিসর আছে যেখানে আমাদের সমস্ত পূর্ণতা আর ভালবাসা খোঁজার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু এত বড় পৃথিবীর সাথে অনিবার্য বিচ্ছেদ, সেখানে ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা নারকীয় জগৎই প্রতিষ্ঠা পায়। তাই ভাবি কি, আমি এগুলোতেই বেশি মগ্ন ছিলাম। একই সাথে ক্ষুদ্র ও বৃহদ্বিশ্বে আমাদের বাস, কি জানেন, আমরা পারি না, একে অন্যকে ভুলতে।

অ্যাডাম স্মিথ: ধন্যবাদ, ভাল বলেছেন, এই কথাগুলো আমরা নিশ্চিয় অন্যদিন আলাপ করতে পারব।

কাজুও ইশিগুরো: হু... আচ্ছা।

অ্যাডাম স্মিথ: ঠিক এই মুহুর্তে আপনাকে ভাবতে হবে কিভাবে এই প্রেসের ভিড় উদ্ধার করবেন। একেবারে শেষ ভাবনা- এই যে আপনি পুরস্কার গ্রহণ করবেন, এই যে আপনার দিকে মনোযোগের জোয়ার, আপনার অনুভূতি কী?

কাজুও ইশিগুরো: ভাল কথা, আমি ভাবছি ইতিবাচকভাবে। মানে, এটা কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হুলুস্থূল অবস্থা। যখন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম আরেকটা সাধারণ দিনের মতই এই দিনটা হবে না আমার এ ব্যপারে কোন ধারণা ছিল না। আমি মনে করি এটা একটা বিশাল ব্যাপার যেখানে সাংবাদিক, গণমাধ্যম সবাই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নেয়ে এত সিরিয়াস! আমি খুবই শঙ্কিত হবে সেদিন যেদিন কেউ নোবেল পুরস্কার নিচ্ছে আর কেউ তাতে আন্তরিক নয়। সেটাই ভাবাবার কেননা কিছু ভয়ংকর ব্যাপার বিশ্বে ঘটেছে।

অ্যাডাম স্মিথ: সাহিত্যকে উদযাপন করার দিনকে শুভদিন হতে হবে।

কাজুও ইশিগুরো: হুম। আর আমি ভাবি সাহিত্য একটা বিশাল বিষয় হতে পারে; এটা কখন-সখন খারাপের দিকেও যে ধাবিত করে। কি জানেন, আমি ভাবি সাহিত্য নোবেল পুরস্কারের মতো বিষয় বেঁচে থাকার চেষ্টা করে ভালোর দিকে ধাবিত করা নিশ্চিত করতে।

অ্যাডাম স্মিথ: অসাধারণ বলেছেন। হুম, আপনাকে আসলেই অনেক ধন্যবাদ। আর ডিসেম্বরে স্টকহোমে আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য আমরা অপেক্ষা করবো।

কাজুও ইশিগুরো: হুম, তাই থাকুন। হুমম, আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগল মি. স্মিথ।

অ্যাডাম স্মিথ: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

কাজুও ইশিগুরো: ভাল থাকুন। বিদায়।

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি