মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাবলীতে বিশেষ করে গত ৪ নভেম্বর লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির পদত্যাগের পর অনেকেই ফোন করে কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বার্তা দিয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন- সৌদি আরব কী ইরানের ওপর হামলা চালাবে? যদি হামলা চালায় তাহলে তার পরিণতি কী হবে? মধ্যপ্রাচ্যের চলমান এই যে দ্বন্দ্ব, এর সম্ভাব্য পরিণতিই বা কী? মুসলিম দেশ হওয়ার পরও কেন সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে এমন আচরণ করছে? সৌদি রাজতন্ত্রের পতন কী আসন্ন? ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর বিশেষ করে তুরস্কের অবস্থান কোন দিকে? অনেকে এ কথাও জানতে চান- যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে ইহুদিবাদী ইসরাইল কী সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? অথবা ইরান কী একা সামাল দিতে পারবে সম্ভাব্য যুদ্ধ?

এরকম নানা প্রশ্ন আমাকে করার কারণ যা বুঝি তা হচ্ছে- আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করি এবং ইরানে থাকি সে কারণে অনেকেই ধারণা করেন আমি হয়ত অনেক বেশি তথ্য জানি। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীতে যে দুটি পক্ষ প্রধান তার একটি পক্ষ হচ্ছে ইরান এবং আমি সেই ইরানে থাকি। অতএব,আমার কাছে অনেক বেশি তথ্য থাকবে- তারা হয়ত এমনটাই ধরে নেন।

একথা ঠিক যে,আমি ইরানে থাকি এবং সাংবাদিকতা করি তবে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো যেহেতু একবারেই রাষ্ট্রের একান্ত গোপন বিষয় এবং সংবেদনশীল সে কারণে এসব কথা আমার জানা থাকার কথা নয়। আমি যেটা করতে পারি তা হচ্ছে-এসব ঘটনার বিশ্লেষণ, যা সম্ভাব্য পরিণতির দিকে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব ও ইরানের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ফলে সেখানে অবস্থান করে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আমার পক্ষে এসব ঘটনার প্রতি বিশেষ নজর রাখা সহজ হয়। এবং সে কারণে ঘটনার সম্ভাব্য ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ করাও বোধ হয় কিছুটা সহজ। যাহোক, পাঠক মনের নানা প্রশ্ন ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাবলী নিয়ে আজকের লেখায় নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। আশা করি তার ভেতর দিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব মিলবে। তবে চলমান এসব ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা,তাদের আকাঙ্ক্ষা,ইসরাইলের তৎপরতা ও ভূমিকা,সৌদি আরবসহ গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশগুলোর অনুসৃত নীতি এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,বিশ্ব রাজনীতিতে দ্রুতগতির পরিবর্তন ও সম্ভাব্য জোট গঠনের বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি।

পাশাপাশি ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও দিন দিন তেহরানের বেড়ে চলা প্রভাবের দিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে। একইসঙ্গে ধর্মীয় দিক বিশেষ করে শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বের দিকটাকে গৌণ করে দেখার একটা মানসিকতা থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে- মধ্যপ্রাচ্যে যত কিছু ঘটছে তার পেছনে শিয়া-সুন্নির যতটা না প্রবল তার চেয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা প্রভাব থাকবে কী থাকবে না তারই দ্বন্দ্ব অনেক বেশি জোরালো। আর সেই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা আমেরিকা ও পশ্চিমাদের হয়ে এমনকি ইসরাইলের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে। কেউ কেউ বিষয়টি এরইমধ্যে বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং আশা করা যায় ধীরে ধীরে সেসব দেশ মার্কিন প্রভাব বলয়থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে- যেমনটি তুরস্কের ইদানিংকালের ভূমিকায় স্পষ্ট হচ্ছে।

ফিরে আসি মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাবলীতে এবং যেসব প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই এখনকার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। প্রথম কথা হচ্ছে- সৌদি আরব ইরানের ওপর হামলা চালাবে কিনা?হামলা চালাবে কিনা সম্পূর্ণ সৌদি সরকারের বিষয়। তবে তারা যেহেতু মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর শলাপরামর্শে কিংবা আদেশ-নির্দেশে কাজ করে সে কারণে সিদ্ধান্তটা মূলত পশ্চিমা জগত থেকেই আসতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হয় না সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে যাবে। আমেরিকাও বিষয়টিতে উৎসাহ বোধ করবে বলে মনে হয় না। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে আমার দৃষ্টিতে সবার ওপরে যে কারণ তা হচ্ছে- সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার মিশনে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি হতে চান সৌদি আরব ও গোটা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনকুবের।

ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে যা সৌদি আরবের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করেছে। এসব মিশন সম্পন্ন করতে যুবরাজের প্রচুর অর্থ ও ক্ষমতার দরকার। আপাতত দ্রুতগতিতে অর্থের চাহিদা মেটানো যাবে সৌদি প্রিন্স ও মন্ত্রীদের আটক করে তাদের অর্থ ছিনিয়ে নিতে পারলে। সেই মিশন সম্পন্ন করতে রাজা সালমান বিন আবদুল আজিজের সহায়তায় অত্যন্ত আকস্মিকভাব গঠন করা হয়েছে দুর্নীতি-বিরোধী কমিটি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালসহ ১১ প্রিন্স এবং বর্তমান ও সাবেক ৩০ মন্ত্রীকে আটক করা হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নাম দেওয়ার ফলে কাজটা সহজেই করা গেছে। অনেকের সমর্থন মিলেছে। কিন্তু রাজপরিবারের যাদেরকে আটক করা হয়েছে তার সংখ্যাটা অনেক বেশি। ফলে গোটা সৌদি আরবে নাড়া লেগেছে শক্তভাবে। এখন সেই টালমাটাল অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য এবং দেশের ও বাইরের লোকজনের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরানোর জন্য ইরান ও হিজবুল্লাহকে অভিযুক্ত করে সাদ হারিরির পদত্যাগ নাটক সাজানো হয়েছে। বলে রাখি, আটক প্রিন্স ও মন্ত্রীদের সম্পদের বিষয়ে এরইমধ্যে সৌদি সরকার বলেছে, এসব ব্যক্তির দুর্নীতি প্রমাণ হলে তাদের সম্পদ জব্দ করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না- রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মালিক এখন যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান। এসব অর্থ তিনি খরচ করবেন- পরিকল্পিতস্মার্ট শহর প্রকল্পে। বলা হচ্ছে- নিউ ইয়র্ক শহরের চেয়ে আধুনিক ও বড় এলাকা নিয়ে এমন স্মার্ট শহর প্রতিষ্ঠা করা হবে; সে শহরে থাকবে না সৌদি আরবে প্রচলিত ইসলামি ভাবধারা।

পাশাপাশি আরেকটা বিষয় থেকে লোকজনের দৃষ্টি সরাতে চান যুবরাজ ও তাঁর বাবা রাজা সালমান। তা হচ্ছে- ইয়েমেন ও সিরিয়া যুদ্ধে নিজেদের ব্যর্থতা। এ দুটি দেশের সঙ্গেই সৌদি আরব দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ৩২ বছর বয়সী তরুণ যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানের একক সিদ্ধান্তে। সিরিয়াতে চরম পরাজয় হয়েছে এবং ইয়েমেনে চোরাবালিতে আটকে গেছে সৌদি সরকার। সেখান থেকে না পারছে বের হতে,না পারছে যুদ্ধ বন্ধ করতে। এ‌ ব্যর্থতার দায়ভার পুরোটাই যুবরাজ মুহাম্মাদের। ফলে ইরানকে দোষারোপ করে দেশের ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের লোকজনের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেওয়া হচ্ছে চলমান ঘটনাবলীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এজন্যই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে ডেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার পরপরই ইয়েমেন থেকে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করা হয়েছে।

এসব ঘটনা ঘটিয়ে প্রধানত সৌদি আরব ও ইসরাইল কিছু লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য- সৌদি আরব ও ইসরাইলের স্বার্থ এখন এক সূঁতোয় বাধা। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরপরই ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত ইসরাইলি কূটনীতিকদের সৌদি আরবের পক্ষে লবিং করার জন্য জরুরি বার্তা দিয়েছে এবং এ খবর দিয়েছে খোদ ইসরাইলের টেলিভিশন চ্যানেল-১০ নিউজ।

এসব অভিযোগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সংকটের জন্য ইরানকে চিহ্নিত করতে চায় সৌদি আরব। অথচ ইরানের রয়েছে ব্যাপক সামরিক-কূটনৈতিক সফলতা। যেখানে সৌদি আরব ও ইসরাইল সিরিয়া ও ইরাকের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র,অর্থ,প্রশিক্ষণ,চিকিৎসা এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সহায়তা দিচ্ছে সেখানে ইরান কার্যকর সামরিক পরামর্শ দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে বিজয় অর্জনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। যেখানে ইসরাইল ও সৌদি আরব হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মতো জনপ্রিয় সংগঠনকে ধ্বংস করতে চায় সেখানে ইরান এ দুটি সংগঠনকে সরাসরি সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে দিন দিন শক্তিশালী করে তুলেছে এবং সে শক্তি এখন ইসরাইলের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে- ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হিজবুল্লাহ ও হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ। সেসব যুদ্ধে হয়ত লেবানন ও গাজার অনেক বেসামরিক লোক শহীদ হয়েছেন কিন্তু হামাস-হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি ধ্বংস করতে কিংবা তাদেরকে বিনাশ করে দিতে পারে নি ইসরাইল। বরং ভাবনার বাইরে ইসরাইলের সামরিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া,সিরিয়া যুদ্ধে মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করে হিজবুল্লাহ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার মূল্য অনেক। কারণ সিরিয়ায় লড়াই করতে হয়েছে ইসরাইল ও আমেরিকার প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের বিরুদ্ধে।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর তেহরানকে মোকাবেলা এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাশ্চাত্যের পরামর্শে ৩৬ বছর আগে গঠন করা হয় উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি। কিন্তু এতদিনে এই সংস্থাটি খুব একটা কার্যকর সংগঠনে পরিণত হতে পারে নি বরং তাদের ভূমিকা দিন দিন ইরানকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করেছে।কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব কার্যত সেই জিসিসি ভেঙে দিয়েছে।পক্ষান্তরে কাতার ভিড়েছে ইরানের বন্দরে। যে ইরানকে মোকাবেলার জন্য জিসিসি গঠন করা হয়েছিল তার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য এখন ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেটা ইরানি কূটনীতির বড় সাফল্য। পাশাপাশি এ সংস্থার দুই সদস্য কুয়েত এবং ওমান অনেক নিরপেক্ষা অবস্থান নিয়েছে যা ইরানকে আলাদা সুবিধা দিচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুরস্ক হচ্ছে কথিত সুন্নি ও সৌদি ব্লকের দেশ এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সদস্য। সেই দেশও এখন ইরানের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলছে এবং কাতার ইস্যুতে ইরান ও তুরস্কই দোহার প্রধান মিত্র। এ দুটি দেশ খাদ্য এবং ওষুধসহ জরুরি পণ্যসামগ্রী নিয়ে কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়া ইস্যুতে যেখানে ইরান ও তুরস্কের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতে সেখানে তুরস্ককে এই অবস্থানে আনতে পারাটাও ইরানের জন্য বড় সফলতা। সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান মডারেট ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা দিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বরেছেন,"ইসলামে উদারপন্থি বা অনুদারপন্থি বলে কিছু নেই;ইসলাম একটাই। উদারপন্থি ইসলামের ধারণা পাশ্চাত্য থেকে সৃষ্ট। আপনি নিজে ইসলামকে ধারণ করেন না এবং আপনি ইসলামের কেউ নন।"এ মুহূর্তে এরদোগানের এই বক্তব্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।এ বক্তব্য দিয়ে এরদোগান মূলত সৌদি অবস্থানের বিপরীতে নিজের অবস্থান ঘোষণা করলেন।মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীতে ইরান যেখানে কূটনৈতিকভাবে দারুনসব সফলতা অর্জন করেছে সেখানে সৌদি আবর বার বার যুদ্ধে জড়ানোর কালিমা গায়ে মেখেছে। ইরানের এ সফলতা ম্লান করতে চায় সৌদি আরব,ইসরাইল ও আমরিকা।

সৌদি আরব ও ইসরাইল এ মুহূর্তে আরো একটি কারণে ইরানের বিরুদ্ধে একজোট। সেটা হচ্ছে পরমাণু চুক্তি বানচাল করা এবং ইরানের ওপর সম্ভব হলে পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনা। ২০১৬ সালে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু চুক্তি বাস্তবায়ন শুরুর পর থেকে ইরান অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থান চলে যাচ্ছে। কারণ এ চুক্তির ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ হয় নি;শুধুমাত্র কিছু কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার সুবিধা পাচ্ছে। পরমাণু কর্মসূচির প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সবই ঠিক আছে এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত পরমাণু কর্মসূচি চলছে। অথচ ইসরাইল চেয়েছিল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস করা হোক। কিন্তু তা হয় নি বরং চুক্তির মাধ্যমে ইরান অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে। ইসরাইলের কাছে বিষয়টি ভালো লাগছে না। এ কারণে সৌদি আরবের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে পদত্যাগ নাটকের ঘটনা ঘটিয়েছে। লেবাননের সংবিধান অনুসারে- সাদ হারিরি হচ্ছেন সুন্নি জোটের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সৌদি আরবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বলা যায়- তার বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য সবই সৌদি আরবভিত্তিক এবং তার জন্মও সৌদি আরবে। তার ওপর সৌদি আরবের বিশেষ প্রভাব রয়েছে এবং সেই প্রভাব খাটিয়ে সৌদি রাজা ও যুবরাজ সাদ হারিরিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। পদত্যাগের সময় সাদ হারিরি যে লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছেন তা নিজের নয় বরং সৌদি আরবের নির্দেশিত বক্তব্য বলে অভিযোগ করেছে হিজবুল্লাহ। পদত্যাগের ঘোষণায় তিনি বলেছেন,ইরান ও হিজবুল্লাহর কারণে তার জীবন হুমকির মুখে এবং লেবাননসহ আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইরান ও হিজবুল্লাহ হস্তক্ষেপ করছে। এসব অভিযোগের মূল কারণ হচ্ছে- লেবাননের সরকারে হিজবুল্লাহর যে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তা বাতিল করতে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা। হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে আমেরিকা। ইউরোপের দেশগুলোও যেন একইরকমভাবে বিষয়টি দেখে- তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছে ইসরাইল। কারণ আগেই বলেছি, হিজবুল্লাহ হচ্ছে ‌ইসরাইলের নিকটতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। হিজবুল্লাহকে নির্মূল করা মানে ইরানের একটি সহযোগী শক্তিকে ধ্বংস করা। আবারইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ তোলার মানে হচ্ছে- ওই সেই ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক বিশেষ করে ইউরোপের চাপ বাড়ানোর কৌশল। এসব চাপ বাড়ানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরমাণু চুক্তি থেকে ইউরোপের দেশগুলোকে সরে আসতে প্রলুব্ধ করা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এখনই এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান। কিন্তু ইউরোপ তার বিরোধী। ফলে ইউরোপকে ইরান-বিরোধী শক্ত অবস্থানে আনার চেষ্টা করছে মূলত ইসরাইল। এ কাজে ব্যবহার করছে সৌদি আরবকে।সৌদি আরবের সামনে ইসরাইল নিজেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরতে চায়; তাতে আঞ্চলিক আরব দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে তার সুবিধা হবে।

হামলার চিন্তা করবে না সৌদি:

প্রধানত যে কারণে ইরানের ওপর হামলার চিন্তা করবে না সৌদি আরব তা হচ্ছে- সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ইরান অনেক এগিয়ে। সৌদি আরবের একার কাছে সেই শক্তি নেই যা দিয়ে সে ইরানকে মোকাবেলা করবে। ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর একাংশের মোকাবেলায়ই সৌদি আরব হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ইরানের মতো বিশাল শক্তির দেশকে কী করে মোকাবেলা করবে?আবার ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করবে- তাতে হিসাব ও সমীকরণ পাল্টে যাবে। আমেরিকাও জানে- ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে তার ন্যুনতম অবস্থান হারাতে হবে। এছাড়া,মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘদিন ধরে অনেক বেশি ডামাডোলের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ইরানের মতো গুরুত্বপূর্ণ তেলশক্তির দেশকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেললে আন্তর্জাতিক বাজার হয়ে উঠবে মারাত্মক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত। এসব হিসাব মাথায় রাখতে হচ্ছে। পাশাপাশি ইরানের মতো দেশের বড় কোনো ক্ষতি হলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং মার্কিন প্রভাব বাড়বে। তাতে চীন ও রাশিয়ার কৌশলগতও অর্থনৈতিক নানা রকমের ক্ষতি হবে। ফলে বিশ্বের এ দুই গুরুত্বপূর্ণ শক্তিও চাইবে না ইরানের বিরুদ্ধে কেউ হামলা করুক। এছাড়া,সিরিয়া এবং ইরাকে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে রাশিয়া ও চীন ইরান বলয়ে রয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী নতুন জোট গড়ে ওঠার যে প্রচেষ্টা চলছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে সম্ভাব্য জোটের সদস্য রাশিয়া,চীন,পাকিস্তান,তুরস্ক,ইরাক,সিরিয়া,লেবানন এমনকী কাতারও চাইবে না ইরানের বিরুদ্ধে কেউ হামলা করুক এবং মধ্যপ্রাচ্যে যু্দ্ধের নতুন কোনো ফ্রন্ট খুলুক। বড় জোর ইসরাইল ও সৌদি আরব মিলে হিজুবল্লাহর ওপর হামলা করতে পারে। তবে সেখানেও তাদের আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না বরং এসব অন্যায়-অপকর্মের কারণে সৌদি রাজতন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হতে পারে। অবশ্য,একথাও ঠিক যে,কথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য যুবরাজ মুহাম্মাদ সৌদি আরবে কথিত গণতন্ত্র চালু করতে পারেন যার বাইরের রূপ হবে এক আর ভেতরের রূপ হবে আরেক। সেটা না হবে গণতন্ত্র;না হবে রাজতন্ত্র। এসবের যাই কিছু করুন না কেন তিনি,দিনে দিনে রাজতন্ত্রেরই পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে, কারণ রাজতন্ত্র হচ্ছে অন্যায় ও জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা। অন্যায়ের পরিণতি হয় নির্মম। সম্ভবত সৌদি রাজপরিবার ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক,রেডিও তেহরান।