অধুনা রাখাইন নামে চিত্রিত সাবেক আরাকান রাজ্য হইতে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থী  প্রশ্নে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একমত হইয়াছে। শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রশ্নে দুই পক্ষ একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করিয়াছে। কি আছে বা কি নাই এই সমঝোতা স্মারকে, তাহা লইয়া নানাবিধ প্রশ্ন তোলা হইতেছে। প্রথানুযায়ী বা প্রশ্নগুলি অবসানে শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করিয়াছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলিয়াছেন, ২৩শে নভেম্বর ঢাকায় যে সমঝোতা স্মারক সহি হইয়াছে তাহা মিয়ানমারের ইচ্ছায় ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করিয়া করা হইয়াছে।

মন্ত্রীর ভাষায়, এখন নতুন চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৯ই অক্টোবর ও গত ২৫ শে আগস্টের পরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরৎ লইবে মিয়ানমার। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের আগে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও বিবেচনা করা হইবে বলিয়া জানাইয়াছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হইবে, তিন সপ্তাহের মধ্যে গঠিত হইবে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ ও এর কাজ করিবার পরিধি।

এই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার খুটিনাটি ঠিক করিবে, দরকার পড়িলে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাকে সামিল করিবে। কোন জটিলতা দেখা দিলে দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করিবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলিয়াছেন, মিয়ানমার ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করিতে চাহিয়াছে বলিয়াই সেইভাবে করা হইয়াছে, কি আছে বা কি নাই তাহা বলিয়া লাভ নাই, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরৎ লইতে চাহিয়াছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করিবার সময় সীমা বলা সম্ভব নহে বলিয়া জানাইয়াছেন মন্ত্রী। বলিয়াছেন, সময়সীমা দিয়া লাভও নাই।

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যে মনে হইয়াছে মিয়ানমার যেমন চাহিয়াছে. বাংলাদেশ তেমনটি করিয়াছে মাত্র। অনেক মৌলিক প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকিয়া গেলেও মিয়ানমার যে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করিয়াছে তাহাই বাংলাদেশের জন্য বড় সাফল্য।

কূটনৈতিক বিচারে কোনটা সাফল্য, কোনটা ব্যর্থতা তাহা অনেক সময়ই তাৎক্ষণিকভাবে বিচার করা যায় না, সত্য। কিন্তু মন্ত্রীর ভাষায় মিয়ানমারের চাওয়া মোতাবেক যদি সমঝোতা হইয়া থাকে তাহা হইলে সাধারণ দৃষ্টিতে বলিতে হয়, সমঝোতা স্মারকে তাহারা মিয়ানমারের স্বার্থ ষোল আনা সংরক্ষণ করিয়াছেন। চুক্তিতে যদি কোন ফাঁকফোকর বা অস্বচ্ছতা থাকিয়া থাকে তাহাও তাহারা রাখিয়াছেন অসৎ উদ্দেশ্যেই।

তাহা ছাড়া যে ১৯৯২ সালের চুক্তি মোতাবেক তাহারা বর্তমান সমঝোতা চাহিয়াছে তাহা তো তাহারা বরাবর বরখেলাপই করিয়া চলিয়াছেন। সেই চুক্তি মোতাবেক পুনরায় করা সমঝোতা তাহারা মানিয়া চলিবে তাহার গ্যারান্টি কোথায়?

যতদূর বোঝা যাইতেছে বর্তমান সমঝোতায় চীন ও ভারত বিশেষ ভূমিকা রাখিয়াছে। সেটা যদি হইয়াই থাকে তাহা হইলে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তাহারা দৃশ্যমান হইলে চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের উপর বাড়তি চাপ থাকিত।

কিন্তু অপর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হইয়া উঠিয়াছে তাহা হইল, যে রোহিঙ্গাদের লইয়া সংকট, তাহাদের কেন পক্ষ করা হইল না? তাহাদের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, সেটা তাহদেরই ভাল বুঝিবার কথা। অতীতে যেমন এবারও তেমনই এই নির্যাতিত রোহিঙ্গা নামক জনগোষ্ঠী উপেক্ষিতই থাকিয়া গেল।

আবার বাংলাদেশ যেহেতু মনে করে, রোহিঙ্গারা আরাকানী আর আরাকান মায়ানমারেরই একটি রাজ্য; সেইহেতু মায়ানমারের নিজস্ব নাগরিকদের সহিত তাহাদের সরকারের সমস্যা সমাধানে বা সমঝোতায় বাংলাদেশ পক্ষ না হইয়া বরং মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আসিতে পারিত। তাহাতে ইহাও প্রতিষ্ঠা করা যাইত যে, রোহিঙ্গা সমস্যা মায়ানমারের নিজস্ব সমস্যা। মায়ানমারের নিজস্ব বাসভূমি হইতে বিতাড়িত কিছু অসহায় মানুষকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়া মানবিক দায়িত্ব পালন করিতেছে মাত্র।

আমার মনে হয়, ইহার জন্য বাংলাদেশকে আরো বেশী কূটনৈতিক তৎপরতা দেখাইতে হইত। সমস্যা সমাধানে আরো বেশী সময় লইতে হইত। সময় গড়াইলে, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িলে, পরিস্থিতি বাংলাদেশ তথা রোহিঙ্গাদেরই অনুকূলে আসিত।

কেন তাহা হইল না তাহার জবাব পাইবার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করিতে হইবে। তবে এতটুকু বলা যায়, এই সমঝোতা স্মারকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হইবে মনে করিবার কোন কারণ আপাতত মনে হইতেছে না।