গত ২৬ নভেম্বর আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর উত্থান ও সৌদি আরবের নেতিবাচক রাজনীতির নানা দিক নিয়ে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী একটি প্রতিবদেন তুলে ধরেছেন লেবাননে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক এরিন কানিংহাম এবং তুরস্কের প্রতিনিধি লুইজা লাভলাক। প্রতিবেদনটি এরইমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। লেখার বিষয়বস্তুতে আমি নিজেও মুগ্ধ। এ কারণে চলতি সপ্তাহে মৌলিক কোনো কলাম না লিখে ওয়াশিংটন পোস্টের লেখাটি অনুবাদ করে পাঠকদের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। আশা করি হিজবুল্লাহ ও সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। হিজবুল্লাহ আজকে যে শক্তি অর্জন করেছে তার কারণও পরিষ্কার হবে। চলুন মূল প্রতিবেদনে যাওয়া যাক।……

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণে হিজবুল্লাহর ওপর কয়েকটি আরব দেশ চাপ বাড়ালেও লেবাননের শিয়া গেরিলা সংগঠনটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, লেবাননের সীমানার বাইরেও সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে এবং দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সংকট সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করছে। 

যখন মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, যখন সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত সংঘাত জোরদার হয়েছে তখন এ সংগঠনের এমন উত্থান হয়েছে। সৌদি আরব হিজবুল্লাহকে ইরানের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিনিধি মনে করে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হিজবুল্লাহ আন্দোলনকে কোণঠাসা করতে সৌদি আরব সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির পদত্যাগের ঘটনা হিজবুল্লাহর শক্তিশালী অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে অনেক বেশি।

মার্কিন ও লেবাননের সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুসারে, হারিরিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে সৌদি আরব এবং লেবাননের জোট সরকার ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করেছে যে সরকারে হিজবুল্লাহরও মন্ত্রী রয়েছেন। সৌদি আরব আশা করেছিল- এ পদক্ষেপে ইরানের অবস্থান দুর্বল হবে এবং শিয়া গেরিলা সংগঠনটির বিরুদ্ধে আগ্রাসী পদক্ষেপের পথ সহজ হবে। 

কিন্তু এর বিপরীতে, লেবাননের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন দেন এবং হিজবুল্লাহকে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাকারী শক্তি বলে তার প্রতিও তারা সমর্থন ঘোষণা করেন। পদত্যাগের পর দেশে ফিরে সাদ হারির ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি তার পদত্যাগপত্র স্থগিত করছেন এবং তিনি লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

এখন হিজবুল্লাহ তার রাজনৈতিক ও সামরিক দক্ষতা এবং লেবাননে বিশাল সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই ঘটনা থেকে লাভ তোলার পথে রয়েছে। দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর শক্ত অবস্থান রয়েছে এবং ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সেখানেই এ সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। সেই দক্ষিণ লেবাননে, সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে সবখানেই হিজবুল্লাহ এখন ক্রমবর্ধমান শক্তি, হিজবুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি অনেকেরই নেই।

ক্যারেঞ্জি মিডল ইস্ট সেন্টারের অনাবাসিক বিশেষজ্ঞ রাফায়েল লেফেভরে বলছেন, “সৌদি সরকার আশা করেছিল হারিরির পদত্যাগ একটি বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি করবে; এর ফলে লেবাননের মন্ত্রিসভা দ্রুতই বিলুপ্ত হবে এবং হিজবুল্লাহ ও তার মিত্র মন্ত্রীরা মন্ত্রিপরিষদ ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থেকে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু অবশ্যই তা ঘটে নি।”

তিনে বলেন, ইরান সমর্থিত দামেস্ক সরকারের সঙ্গে মিলে সিরিয়ায় উগ্রবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এবং “লেবাননের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণকেন্দ্রে এর প্রভাব এখন নিশ্চয় যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি”।

লেবানন হচ্ছে মাত্র ৬০ লাখ জনসংখ্যার একটি জাতি। দেশটির প্রধান ধর্মীয় গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। গ্রুপগুলো হলো- খ্রিস্টান, সুন্নি ও শিয়া মুসলিম। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হন সুন্নি মুসলিম, জাতীয় সংসদের স্পিকার হন শিয়া এবং প্রেসিডেন্ট হন খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে। লেবাননের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও স্পিকার দুজনই হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ। লেবাননের জাতীয় সংসদে হিজবুল্লাহর ১১টি আসন এবং দুজন মন্ত্রী রয়েছেন।

কিন্তু এই সংগঠন লেবাননের আনুষ্ঠানিক শক্তির বাইরে থেকেও শক্তি সঞ্চয় করেছে, শক্তি সঞ্চয়ের সে উৎস হচ্ছে সামাজিক সেবা। হিজবুল্লাহ যেমন রাজনীতির ‘কিংমেকার’ তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও এগিয়ে। তাদের হাতে রয়েছে রাষ্ট্রীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরের সামরিক শক্তি, রয়েছে ইরানের সমর্থন।

হিজবুল্লাহর শক্তি লেবাননের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতাকে ম্লান করে দেয়। এর সামাজিক সেবাকার্যক্রম স্কুল থেকে স্বেচ্ছাসেবা, প্রযুক্তিগত সহায়তা থেকে কৃষি- সবখানে বিস্তৃত। তাদের এই সামাজিক সেবাগুলো শিয়াসহ অন্য সব সম্প্রদায়কে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরাক, লেবানন ও সিরিয়া প্রকল্পের পরিচালক হেইকো উয়িম্মেন বলেন, “হিজবুল্লাহর সক্ষমতা যদিও ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’র মতো তারপরও এরাই হচ্ছে লেবাননে বিকল্প সবকিছুর যোগানদাতা।”

তিনি বলেন, “সংকটের সময়, যখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল তখন হিজবুল্লাহ দেশের জনগণকে যে সেবা দিয়েছে সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তারা যেমন তাদের সম্প্রদায়ের মাঝে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেছে তেমনি অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে নিজেদের নিরাপদ অবস্থান গড়ে তুলেছে।”

ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গেরিলা শক্তি হিসেবে হিজবুল্লাহর জন্ম হয়েছিল। দক্ষিণ লেবাননের জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি সে কঠিন লড়াই করেছে ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। হিজবুল্লাহর ভয়াবহ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ইসরাইল তার সেনাদেরকে লেবাননের ভূখণ্ড থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ করেছে হিজবুল্লাহ। যদিও সে যুদ্ধে ঠিক সেভাবে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয় নি তবে সে যুদ্ধ হিজবুল্লাহকে প্রতিরোধী শক্তির মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধে এ সংগঠনটি দেশীয় সীমারেখা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠনের মর্যাদা অর্জন করেছে, যুদ্ধ করেছে আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

রাফায়েল লেফেভরে বলছেন, “সিরিয়ায় হিজবুল্লাহ শত শত যোদ্ধা হারিয়েছে কিন্তু আরো বহু নতুন যোদ্ধা রিক্রুট করেছে এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যা হিজবুল্লাহকে প্যারা-মিলিটারি থেকে প্রকৃত মিনি-আর্মির সক্ষমতা দিয়েছে। আগে হিজবুল্লাহ গেরিলা যুদ্ধ করত এখন তাতে সীমাবদ্ধ নেই।”

রাফায়েল বলেন, “হিজবুল্লাহর এখন নিজস্ব ট্যাংক ডিভিশন এবং স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট রয়েছে যারা সিরিয়া ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে যুদ্ধ করছে এবং শত্রু কবলিত এলাকায় জটিল যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ সংগঠন ইরান থেকে নগদ অর্থ ও অস্ত্র পায়। এই ইরানই হিজবুল্লাহকে গড়ে তুলেছে।”

সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা লেবাননের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে উগ্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। লেবাননী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হলেও সেনাবাহিনী পেছনের কাতারেই ছিল।

হিজবুল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মাদ ওবেইদ বলেন, “যখন লেবাননের সরকার তার দায়িত্ব পালন করে না তখন হিজবুল্লাহ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য। জনগণকে রক্ষার জন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে।”

সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলোর মাধ্যমে লেবাননের আরসাল ও কালামুন শহর থেকে হিজবুল্লাহ ও দেশটির সামরিক বাহিনী আল-কায়েদা এবং আইএস সন্ত্রাসীদের বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়। ওবেইদ বলেন, “এই সমন্বয়ের অর্থ এই নয় যে, হিজবুল্লাহ লেবাননের সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু কাজটা লেবাননের সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই সহজ ছিল না।….এবং হিজবুল্লাহ সবখানেই আছে।”

জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, বিশেষ করে বহু লেবাননী নাগরিক যখন সৌদি তৎপরতাকে আগ্রাসন হিসেবে দেখছেন তখন হিজবল্লাহকে পুরো জাতির সমর্থন পেতে হবে। সংগঠনটি এরইমধ্যে লেবাননের সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে এবং সরকারের ভেতরে ও বাইরে সুন্নি মিত্রদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে।

হারির যিনি একজন সুন্নি তিনি দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তিনি যখন গত ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন তখন হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সৌদি সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, সৌদি সরকার হারিরিকে আটক করেছে। প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে অবিলম্বে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্যও তিনি রিয়াদের প্রতি আহ্বান জানান।

উয়িম্মেন বলেন, “হিজবুল্লাহ নিশ্চয় সুন্নি মিত্র চায়। সামগ্রকিভাবে এই সংগঠনের তৎপরতা অন্তত বাহ্যিকভাবে সাম্প্রদায়িক নয়।”

এরইমধ্যে, এমনকি লেবাননের যেসব নাগরিক যারা বলেন যে, তারা হিজবুল্লাহর সঙ্গে জড়িত নন তারাও এই সংগঠনের উৎসাহী সমর্থকে পরিণত হয়েছেন।

বিলাল বালুত নামে দক্ষিণ লেবাননের একজন অর্থ সংগ্রহকারী এজেন্ট বলেন, “বহু মানুষ আছেন যারা রাজনৈতিক কারণে হিজবুল্লাহকে সমর্থন করেন কিন্তু বহু মানুষ আছেন যারা মনে করেন হিজবুল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করছে; সে কারণে তারা হিজবুল্লাহকে সমর্থন করেন।” বিলাল বলেন, “লেবাননের সেনারা যতটা পারছে ততটা আমাদেরকে সেবা দিচ্ছে কিন্তু হিজবুল্লাহর বহু সেনা আছে।”

তিনি বলেন, “যখন আপনি জনপ্রিয়তার শক্তি পাবেন তখন আপনি রাজনৈতিক শক্তিও পাবেন। এবং হিজবুল্লাহ প্রতিদিনই সেই সমর্থন পাচ্ছে এবং শক্তিশালী হচ্ছে।”

অনুবাদক : সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান