মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনের পবিত্র জেরুজালেম শহরকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করার পর ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত ‘জাহান্নামের দরজা খুলে দেবে’। হামাস আরো বলেছে, ‘জেরুজালেম বিষয়ক ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এই বাস্তবতাকে পাল্টে দিতে পারবে না যে, জেরুজালেম হচ্ছে আরব ও মুসলমানদের ভূমি।’ ট্রাম্পের ঘোষণার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদেরও ডাক দিয়েছে হামাস। ফিলিস্তিনের অন্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোও প্রতিবাদ করছে, বিক্ষোভ করছে। সবচেয়ে আপোষকামী দল প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ আন্দোলনও ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করেছে এবং আমেরিকার সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধের কথা জানিয়েছে। 

ট্রাম্পের ঘোষণার পর প্রতিদিন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে; ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেনা ও পুলিশের সঙ্গে অসহায় ফিলিস্তিনিদের সংঘর্ষ হচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত আট ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং এ লেখা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছাবে তখন হয়ত সে সংখ্যা বেড়েও যেতে পারে। নিহতের তালিকায় রয়েছেন গাজা উপত্যকার পঙ্গু ইব্রাহিম আবু সুরাইয়া। ২৯ বছর বয়সী এ তরুণ দুটি পা হারিয়েছিলেন ২০০৮ সালে।

২০০৮ সালে গাজা উপত্যকার ওপর সামরিক আগ্রাসন চালায় ইহুদিবাদী ইসরাইল কিন্তু হামাসের তীব্র প্রতিরোধের মুখে গাজার কেন্দ্রস্থলে ঢুকতে পারেনি ইহুদিবাদী সেনারা। ফলে গাজার ওপর ব্যাপকভাবে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। সেই বিমান হামলায় দুটি পা উড়ে যায় সুরাইয়ার। ডাক্তাররা তার উরুর ওপর থেকে কেটে ফেলেন, পঙ্গু হয়ে যান সুরাইয়া। অর্থাৎ হাঁটার আর কোনো উপায় ছিল না। পা গেলেও ইব্রাহিম সুরাইয়া জীবনে বেঁচে যান। জীবনের মতো পঙ্গুত্বকে সঙ্গে করে তিনি কোনোরকমে জীবনধারণ করছিলেন। নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের ভার ছিল পঙ্গু সুরাইয়ার ওপর।

২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকার ওপর সার্বাত্মক অবরোধ দিয়ে রেখেছে ইসরাইল। সেখানকার জনজীবনে নেমে এসেছে মারাত্মক দুর্ভোগ। বিশাল এ পৃথিবী থেকে গাজা উপত্যকার মানুষ বিচ্ছিন্ন। তাদের বের হওয়ার অধিকার নেই, চিকিৎসার অধিকার নেই, মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো ব্যবস্থা নেই। মারাত্মক অসুস্থ রোগীরও বাইরের কোনো দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অধিকার নেই, উপায় নেই। এই যেখানে অবস্থা সেখানে পঙ্গু সুরাইয়ার বেঁচে থাকার কী উপায়-অবলম্বন ছিল? তবুও জীবন থেমে থাকে না; জীবন চলে যায়। ইব্রাহিম সুরাইয়ার জীবনও চলে যাচ্ছিল। তিনি হুইল চেয়ারে চড়ে গাজা উপত্যকার রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি মুছে কিছু পয়সা উপার্জন করতেন। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলে সেখানে মানুষের গাড়ির গ্লাস মুছে দিতেন, গাড়ির গায়ের ধুলো-বালি মুছে দিতেন। লোকজন খুশি হয়ে যা দুই পয়সা দিতেন সুরাইয়া তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। সেই সুরাইয়াকে উগ্র ইহুদিবাদী সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। গুলি করা হয়েছে তার মাথায় এবং গুলি চালিয়েছে ইসরাইলের স্নাইপারেরা। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তারা পঙ্গু সুরাইয়াকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। মারা গেছেন সুরাইয়া। প্রাণ হারানোর আগে সুরাইয়ার শেষ কথা ছিল- ‘এ জমিন আমার; এটা আমার দেশ!’

সুরাইয়ার পা ছিল না তবু হৃদয়ের ভেতরে লালিত ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। বুকে ছিল ঈমান, সেই ঈমানকে পুঁজি করে সুরাইয়া সাম্প্রতিক বিক্ষোভ-মিছিলে প্রতিদিন অংশ নিচ্ছিলেন। ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে প্রতিদিন ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিবাদে রাস্তায় নামছিলেন। সুরাইয়া কিংবা অন্য কেউ হয়ত ধারণা করেন নি- দুই পা হারানো এই পঙ্গু লোকটিকে এইভাবে কাপুরুষের মতো মাথায় গুলি করে হত্যা করবে ইসরাইলি সেনারা! কিন্তু তাই করেছে দখলদার বাহিনী; চিরতরে চলে গেছেন সুরাইয়া।

গুলি করে সুরাইয়ার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়া গেছে কিন্তু ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন কী নিভিয়ে দেয়া যাবে? না, যাবে না। গত ৭০ বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছেন ফিলিস্তিনিরা। হাজারো মানুষের জীবন গেছে, ঘর-বাড়ি গেছে, সহায়-সম্পত্তি গেছে কিন্তু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কেড়ে নিতে পারে নি ইসরাইল। প্রতিটি ফিলিস্তিনি নাগরিকের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলছে ক্ষোভের আগুন। সেই ক্ষোভের আগুনেরই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এক সময় রূপ নেবে গণবিস্ফোরণে; সেই বিস্ফোরণে জ্বলেপুড়ে ছারখার হবে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র। হয়ত মধ্যপ্রাচ্যের এই পবিত্র ভূমি থেকেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের ঘণ্টাধ্বনি বাজবে; হামাসের ভাষায় হয়ত তাদের জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে। কারণ এই আমেরিকার কারণেই আজ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বেদখল, ইসরাইল এত হৃষ্টপুষ্ট, শত-সহস্র ফিলিস্তিনির জীবন গেছে, তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরাইল নামক এই ক্যান্সারের যন্ত্রণা আজ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে সারা মুসলিম বিশ্বে। গাজার রাস্তায় পঙ্গু সরাইয়াদের যে জীবনহানি ঘটে তার দায় সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার; তার দায় গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের।  

ফিলিস্তিনিরা জীবন দিতে জানে। জীবনকে মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন না। যে জাতি জীবন দিতে জানে, যে জাতি রক্ত দিতে শিখে যায় সে জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায়। স্বাধীনতার আকঙ্ক্ষা যার রক্ত-ধারায় মিশে যায় তাকে স্বাধীনতার পথ থেকে ফেরানো যায় না। কিছু আপোষকামী ছাড়া হামাস ও জিহাদ আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এখন প্রতিটি ফিলিস্তিনি নাগরিকের শিরা উপশিরায় প্রবাহমান। ইসরাইল, আমেরিকা ও সৌদি আরব যত ষড়যন্ত্রই করুক ফিলিস্তিনি জনগণকে এই পথ থেকে ফেরানো যাবে না। ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ভাগ করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন নামক দুটি রাষ্ট্র গঠন করা হলেও কীভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা হারিয়ে গেল তার জবাব নিয়ে নেবে এই জনতা। কেন ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জন্য নিজেদের দেশের মাটিতে চলাফেরার স্বাধীনতা থাকবে না তার কৈফিয়ত নিয়ে নেবে একদিন। কেন গাজার লোকজন পশ্চিম তীরে যেতে পারবেন না; কেন পশ্চিম তীরের নাগরিক গাজায় পড়াশুনা করতে পারবেন না কিংবা কেন জেরুজালেমে নিজেদের মাটিতে একটি ঘর বাধতে পারবেন না -তার জবাব চাইবেন একদিন এই ফিলিস্তিনিরা।

জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসসহ বহু নেতা বলেছেন, এখন থেকে আমেরিকাকে আর নিরপেক্ষ মনে করা হবে না। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটে আমেরিকা মধ্যস্থতাকারীর মর্যাদা হারিয়েছে। কী অদ্ভুত কথা! বলুন তো কবে এই আমেরিকা-ব্রিটেন বা পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটে নিরপেক্ষ ছিল? তারাই কী ইহুদি নাগরিক সাপ্লাই দিয়ে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নি? আমেরিকাসহ পশ্চিমা ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশগুলো কী ইসরাইলের অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবগুলো বানচাল করে দেয় নি? তারাই কী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদি নিধনের ভুয়া দাবি তুলে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে দেয় নি? তাহলে তারা নিরপেক্ষ থাকে কী করে? কী করে তারা নিরপেক্ষ শক্তি হয়? এই সত্য কথাটা মাহমুদ আব্বাসরা না বুঝলেও ঠিকই বুঝেছেন হামাস-হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা। সে কারণে শান্তিরক্ষী পাঠানোর নাম করে লেবাননে ইঙ্গো-মার্কিন-ফরাসি বাহিনী পাঠানো হলে ঠিকই তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হয়!

কী ঘটেছিল লেবাননে?

১৯৮৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে দুই দফা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এই শক্তিগুলো; বিশেষ করে আমেরিকা ও ফ্রান্স। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইল আগ্রাসন চালিয়ে দক্ষিণ লেবানন দখল করে নেয়। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বেশিরভাগ শিয়া মুসলমানের বসবাস। ইসরাইলি দখলদারিত্বের কারণে উদ্বাস্ত হয়ে আসা ফিলিস্তিনিরা মাঝেমধ্যে লেবানন থেকে হামলা চালাতেন। এই হামলা বন্ধ ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও’র যোদ্ধাদের বহিষ্কারের নামে ইসরাইর দক্ষিণ লেবানন দখল করে নেয়। ওই বছরই লেবাননের খ্রিস্টান প্রেসিডেন্ট বাশির গেমায়েল আঁততায়ীর হাতে নিহত হন। এর প্রতিশোধ নিতে লেবাননের মারোনাইট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন সাবরা ও শাতিলা ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে হামলা চালায় এবং ১৯৮২ সালের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর দুই শিবিরে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এই হত্যাকাণ্ডের সময় ইসরাইলি বাহিনী সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবির ঘেরাও করে রাখে এবং খ্রিস্টানরা সেখানে ইচ্ছা মতো গণহত্যা চালায়। দু দিনে সেখানে মোট ৩,৫০০ মানুষ নিহত হন যার বেশিরভাগই ছিল কিশোর-কিশোরী ও বৃদ্ধ।

এই ঘটনার পর লেবাননে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তখন গৃহযুদ্ধ থেকে লেবাননকে মুক্ত করে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনার নামে আমেরিকা ও ফ্রান্স লেবাননে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। সেই সঙ্গে ছিল ব্রিটেনসহ আরো কিছু পশ্চিমা দেশ। কিন্তু লেবাননের মুসলমানরা মার্কিন ও ফরাসি সেনাদেরকে শান্তিরক্ষী মনে না করে বরং তাদেরকে গৃহযুদ্ধে জড়িত ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের পক্ষের একটা অংশ মনে করতেন।

এর পাশাপাশি আরো কিছু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে লেবাননে। পশ্চিম বৈরুতের দরিদ্র অঞ্চলে ছিল মুসলমানদের বসবাস। এছাড়া, বৈরুতের বিমানবন্দরের কাছেও তাদের বসবাস ছিল। এর মধ্যে আবার দক্ষিণ লেবানন ছিল শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল যা ইহুদিবাদী ইসরাইল দখল করে নিয়েছিল।

সে সময় লেবাননে মার্কিন সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহর মোতায়েন করা ছিল ভূমধ্যসাগরে। মার্কিন সেনারা বৈরুতের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ঐতিহাসিক শাউফ পাহাড়ি এলাকায় দফায় দফায় গোলাবর্ষণ করে যাতে বহু নীরিহ সাধারণ মানুষ মারা যান। ওই পার্বত্যাঞ্চল ছিল দ্রুজ গেরিলাদের শক্ত ঘাঁটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কামাল জুমব্লাত। এই দ্রুজ সম্প্রদায় লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় মুসলমানদের সমর্থন করত। কামাল জুমব্লাত ১৯৭৬ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও’র নেতা ইয়াসির আরাফাতকে “বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান যোদ্ধা” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। যাহোক, একদিকে দক্ষিণ লেবাননে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও বর্বর শাসন, সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে গণহত্যা এবং শাউফ পাহাড়ি এলাকায় মার্কিন গোলাবর্ষণে বহু নিরীহ লোকজনের প্রাণহানি- সবমিলিয়ে লেবাননের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। যখন জনগণের মধ্যে এত ক্ষোভের সঞ্চয় ঘটে তখন পুঞ্জিভূত ও ধূমায়িত ক্ষোভ, হতাশা এবং অসন্তোষ মানুষকে যেকোনো রকমের জীবনঘাতী ঘটনা সংঘটিত করতে উৎসাহিত করে। সম্ভবত তারই ফল হিসেবে বৈরুতে মার্কিন দূতাবাসে হামলা এবং মার্কিন ও ফরাসি সেনাদের ওপর ভয়াবহ হামলা হয়। এসব হামলায় শত শত সেনার পাশাপাশি মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সদস্য, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও বহু ফরাসি সেনা নিহত হয়।

১৯৮৩ সালের ৮ এপ্রিল বৈরুতের মার্কিন দূতাবাসে হামলা হয় যার ফলে মারা যায় মোট ৬৩ ব্যক্তি। এর মধ্যে ৩২ লেবাননি কর্মী, ১৭ মার্কিনি ও ১৪ জন দর্শণার্থী ও পথিক নিহত হন। নিহত মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে আটজনই ছিল সিআইএ’র লোক। মূলত তখন লেবানন থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএ’র কর্মতৎপরতা পরিচালিত হতো। এই হামলায় নিহত হয়েছিলেন সিআইএ’র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও নিকট প্রাচ্যের পরিচালক রবার্ট সি. অ্যামেস।

লেবাননে মোতায়েন মার্কিন ও ফরাসি সেনাদের ব্যারাকে ওই বছরের ২৩ অক্টোবর হয় ইতিহাসের ভয়াবহ হামলা। ২০০০ পাউন্ড বিস্ফোরক ভর্তি একটি ট্রাক বৈরুত বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন ব্যারাকে আঘাত হানে। ওই হামলায় মারা যায় ২৪১ জন সেনা যার মধ্যে ছিল ২২০ জন মেরিন সেনা। এর মিনিটখানেকের মধ্যে বৈরুতের ফরাসি সেনা ব্যারাকে একই ধরনের একটি ট্রাক হামলা চালানো হয়। তাতে নিহত হয় ফ্রান্সর ৫৮ জন সেনা।

১৯৮২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান শান্তিরক্ষীর নামে লেবাননে এসব সেনা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হামলার পর তিনি লেবানন থেকে মার্কিন সেনাদেরকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। জানিয়ে রাখি- মার্কিন সরকারের হিসাব মতে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আইও জিমার যুদ্ধে ব্যাপক মার্কিন সেনা মারা গিয়েছিল। এরপর লেবাননের এই হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা এবং একদিনে এর আগে এত বেশি মার্কিন সেনা আর মারা যায় নি। একই রকমের বিষয় ছিল ফরাসি সেনাদের জন্যও। হামলার পর ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং স্পেনও সেনা প্রত্যাহার করে।

এসব হামলার জন্য লেবাননের হিজবুল্লাহকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয় পাশাপাশি ইরানকেও দায়ী করা হয়। কিন্তু ইরান সম্পূর্ণভাবে এ হামলার কথা নাকচ করে আসছে এবং হিজবুল্লাহর তো তখন জন্মই হয় নি। তবে একথা ঠিক যে, সেই সময় ইসরাইল, আমেরিকা ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশের বর্বরতা এবং অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে লেবানন ও ফিলিস্তিনের মুসলিম শক্তি যদি এমন হামলা করেই থাকে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।

পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে- ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে এবং প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহ হত্যা-নির্যাতনের কারণে সেই একই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ আত্মঘাতী হয়ে ওঠে এবং জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে যেকোনো ঘটনা ঘটাতে প্রস্তুত হয়ে যায়। ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হচ্ছে- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। কিন্তু আমেরিকা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার ভুল করে তাহলে তাদের সামনে ১৯৮৩ সালের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সম্ভবত ফিলিস্তিনের হামাস তারই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে, “ট্রাম্পের ঘোষণায় জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে।” আমেরিকাকে মনে রাখতে হবে- এটা ১৯৮৩ সাল নয়, এটা ২০১৭; এখন হামাস ও হিজবুল্লাহর অস্তিত্ব আছে এবং তারা সামরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী। বায়তুল মুকাদ্দাসে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নিলে তার ওপর ধ্বংসাত্মক হামলা হবে না- তার নিশ্চয়তা দেয়া মুশকিল।#

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান