প্রারম্ভিকা:

সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এবং তিনি ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম।

বিংশ শতাব্দীর শেষাভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

তার লিখনশৈলী নানাভাবে চিহ্নিত করা যায়।তেমনি একটি নমুনা পত্রস্থ করা হচ্ছে বর্তমান লেখায়।

সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখকের অভিধায় ভূষিত। তার লেখালেখির বহুমাত্রিকতা স্পর্শ করে সব অনুষঙ্গকে তার গদ্যের বিশাল ভান্ডারের পাশাপাশি রয়েছে কবিতার দ্যুতিময় দুনিয়া। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার এই অনুপম পৃথিবীকে যদি দু'ভাগে ভাগ করা যায়-তাহলে দেখা যাবে তার কবিতার একটি ভাগ জুড়ে আছে প্রেমের বাণী, অন্যটি অপ্রেমের। যদিও অপ্রেমের মধ্যেও নিহিত আছে ভালোবাসার ভাবনা। সৈয়দ শামসুল হকের রাজনৈতিক সচেতনতামূলক কবিতার মধ্যে আছে স্বাদেশ প্রেমের অবতারণা।

আপাতদৃষ্টিতে যদি আমরা প্রেমকে নারীর চিত্তজয়ের আকুতি কিংবা শারীরিক সৌন্দর্যের ওপর সমর্পণ করি, তাহলে প্রেমকে শুধু মানব মানবীর প্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব, সেই বিচারে সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের কবিতাগুলোকে আলাদা করা যায়, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় প্রেম ভাবনা উঠে এসেছে নানাভাবে। অন্তরালে থাকে যেজন তার বিরহে বেদনার্ত মনের দুঃখ কবিতাকে ছুঁয়ে যায়।

চুপ করে থাকে সে আড়ালে

হাজার মনের ভিড়ে কখন যে ফোটে

রাত্রির ফুলগুলো লাজুক অবুঝ

একমন উম্মন করে

রাত আসে পাশাপাশি

সোনালী নদীরা বয় দু'জন বিজনে

একজন থাক সে আড়ালে

আমাকে ফেলে

আমাকে ফেলে কোথায় তুমি যাবে

যেখানে যাও অন্ধ-বন, লক্ষ তারার রাত

ব্যথার মতো বাতাস বয়ে যাবে

আমাকে তুমি এড়িয়ে বলো কেমন করে রবে?

ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নেয়ার প্রেমানুভূতির বন্ধনে বেঁধে ফেলার কথা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছেন অবলীলায়। প্রত্যাখ্যান দিয়ে অনুভবকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না কিংবা যাকে ভালোবাসা যায় তার চেতনায় যে ভালোবাসে তার ছায়া থেকেই যায়। প্রেমিকার চোখে গভীরতর স্বপ্ন এঁকে দেয় যে প্রেমিক তাকে ভুলে থাকা যায় না। তার প্রতি বিরাগ করা যায় না। সৈয়দ শামসুল হক এভাবে তার প্রেমের কবিতার বর্ণিল বিন্যাসে ঘুমে ও জাগরণে ভালোবাসারি মানুষের নিত্য বিচরণ, যাপিত জীবনে ভালো মন্দের প্রভাব ভালোবাসার পাত্রের উপরই নির্ভর করে। প্রেমিকের মনে প্রেমিকার ছবি নানা ভাবে ধরা দেয়- কখনো দুঃখের হয়ে আবার কখনো সুখের অনুভূতিতে।

প্রেমিকার প্রতিটি ভূমিকা আলাদা অর্থ বহন করে। আলাদা দৃশ্যপট তৈরি হয়। প্রকৃতি ভিন্নতর চেহারায় রূপায়িত হয়। সৈয়দ শামসুল হক তার ভালোবাসার কবিতায় এ ধরনের চিত্রকল্প তৈরি করেছেন দক্ষতার সাথে

যখন তুমি আধেক মুখ তোলে

ছড়ায় যেন চন্দ্রলোকের তাপ

মুহুর্মুহু গিরি অগ্নিগিরি

ছড়ায় লাভা, ধূম্রজালে মরি

আমার তুমি শত্রু হলে সখি

ঘুমেও কিছু স্বস্তি মেলে নাকো

মিলনে নয়, বিরহে নয় আর

স্মৃতিও নয়, মরণও নয় যেন

কিছুই যেন যথেষ্ট নয় আর

হৃদয়জুড়ে কিসের হাহাকার?

এমন করে বাঁধলে তুমি সখি

আমায় তুমি কঠিন জাগরণে

রেখেছো যেন তীব্র তলোয়ার

বেরিয়ে পড়ে থমকে আছে খাড়।

সৈয়দ শামসুল হক তার কবিতার মাধ্যমে প্রেমের এক ধরনের দর্শন উপস্থাপন করেছেন । নানা রকম উপমা উৎপ্রেক্ষা তার এই গভীরতর দর্শনকে সহজবোধ্য করে তোলে। প্রেমিকার সৌন্দর্যের যে কোনো বিষয়কে তিনি উপজীব্য করে তৈরি করেছেন কবিতার অনুপম অবয়ব। তা হতে পারে চোখ, চুল, কিংবা হাসির ছটা। চোখ শুধু সৌন্দর্যে শোভিত নয়। চোখের একটা স্বতন্ত্র কাজ আছে সেটা দেখা। পৃথিবীর নানা অসঙ্গতি, অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে দেয় চোখ। সে কারণে চোখ কেবল সৌন্দর্য বহন করে না। চোখ এক ধরনের বার্তা বহন করে। প্রেমের কথামালা দিয়ে সৈয়দ হক এই আলাদা বার্তা প্রকাশ করেছেন । উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে—

যখন কেউ কাউকে কথা দেয়

তখন একটি চোখ আঁকা হয়ে যায়

তাকিয়ে থাকে সেই চোখ

নিষ্পলক

হরিণের শিংয়ের মতো চারদিকে

চিৎকার ছোটে

দেখে চোখ দেখে

কবর আমাকে কোল যখন দেবে

সেই চোখ যেন আমাকে জাগিয়ে রাখে।

প্রেমের অন্য নাম আবেগময় অনুভূতি। এই অনন্ত ভুবনে অন্ধ দুরন্ত যুগল মনের অবিরাম ছুটে যাওয়া স্পর্শসুখে ভেতরে ভেতরে নিহত হয়ে যাওয়া, ভালোবাসার খুনসুটিতে সময় পার করা। এই সবই প্রেম। প্রেম মূলত এক ধরনের অগ্নিময় খেলা। এই খেলায় কেউ নির্মিত হয় কেউ বিচূর্ণ হয়। কেউ পুড়ে বেদনার্ত সুখে কেউ আনন্দিত। সৈয়দ শামসুল হক মানব মনের প্রেমের চিরন্তন এই বিষয়কে কবিতায় প্রযুক্ত করেছেন প্রেমের সাত কাহন তিনি কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এই সব কবিতা সার্বজনীন প্রেমের ঈষদুষ্ণ অনুভূতি তৈরি করে। এভাবে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা প্রেমিক পাঠকদের হৃদয় জয় করে নেয়। ভালোবাসা এই মোহন শব্দটি অপার শক্তি হয়ে আবির্ভূত হয়। এই শব্দটি অসুস্থকে নিরাময় করে তোলে নিঃস্বকে সম্পদশালী করে দেয় মানুষ অসীম সষ্ণয়ে সজ্জিত হয়। দুঃখরা যেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়। এ ধরনের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বলেন—

আমার প্রত্যেকটা ক্ষত হয় ফুলের তোড়া

প্রতি দুঃখই আবার সবুজ হয়ে যায়

এবং দুলে ওঠে আবার এক আবার-বাতাসে

তোমাকে ভলোবাসি বলে সষ্ণয় শেষ হয়ে যায় না

প্রতিটি ব্যয় প্রাণের হাটে আবার ফিরে আসে

নতন চকচকে আলো ঝিলিক আধুলি

হয়ে

তোমাকে ভলোবাসি বলে

আমার সমস্ত শোক হয়ে যায় সারি সারি ঘাম

এবং তারা ধারণ করে থাকে আমার স্বপ্নের

দ্বিতল ও তিতল।

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার পৃথিবীতে প্রেমের শব্দের ভালোবাসার বাণীর একটি মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়। যে দেশের মানুষরা হৃদয়বান অনুভূতিপ্রবণ,আবেগপ্রবণ। এখানে হৃদয়ের বিকিকিনি হয় ভালোবাসার মাত্রা দিয়ে। এই মহাদেশ নির্মিত হয়েছে স্বতন্ত্র এক রচনা শৈলী দিয়ে, উপমা চিত্রকল্প, নন্দনতত্ত্ব, নিজস্ব শব্দ চয়ন, সাবলীল ভাষা বিন্যাস ইত্যাদি ভিন্নতার উপপকরণে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের এই মহাদেশের একটি নাম দেয়া যায় সেটা হলো বর্ণিল বিন্যাস। বর্ণিল বিন্যাসে সৈয়দ শামসুল হকের এই ভুবন আখ্যায়িত হোক ।

লেখক : কবি ও গদ্যকার।