শব্দঘর-অন্যপ্রকাশ এর কথাশিল্পী অন্বেষণে অংশগ্রহনকারী তরুণ শিল্পীদের পাঠানো পান্ডুলিপি থেকে নির্বাচিত প্রথমসেরা উপন্যাস আশান উজ জামানের "অন্যচোখে" দেশপ্রেমে অন্ধ এক যুবকের বর্ণনা শুরু গল্পের প্রথম পর্ব সংক্রান্তিতে। সংক্রান্তিতে বর্ণিত ঘটনা বুঝতে গিয়ে পরিচয় হবে দ্বান্দ্বিক মনের এক তরুণ মিলিটারি শামসের সঙ্গে। যে নিজের সাথে দ্বন্দ্ব করছে প্রতিনিয়ত। কখনো নিজেকে দক্ষ সাহসী নির্ভেজাল মুসলমান ভেবে বাঙ্গালিদের উপর গুলি চালাচ্ছে আবার কোন কারণে চোখ গলে কোন বাঙ্গালি পালালে নিজেই নিজেকে তিরষ্কার করছে।

পাকিস্তানকে দুভাগ করে যে বাঙালিরা স্বাধীন হবার চিন্তায় দেশদ্রোহী হয়েছে তাদের উচিত শিক্ষা দিতেই মা,ভাই আর ভালোবাসার মানুষ ফাতিমাকে ফেলে এ সংগ্রামে নেমেছে শামস। বিয়ের জন্য ছুটিও নিয়েছিলো। কিন্তু, বিয়ে করা হয়নি তার। এক সপ্তাহের মাথায় দেশদ্রোহী বাঙ্গালিদের শায়েস্তা করতে যুদ্ধে এসেছে সে। কখনো মায়ের পাঠানো চিঠি, কখনো ছোট ভাই হেলাল কখনোবা পুরনো কলেজ বিল্ডিং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয়তমা ফাতিমার চাতক চাহনী। এসব ভাবনায় যুদ্ধের ময়দানে মাঝে মাঝে সে বিচলিত হয়ে পড়ে। একই সাথে হলের কোন এক ছেলেকে গুলি করতে গিয়ে তার যে স্ববিরোধী মনোভাব এবং সবশেষে লাশের সামনে অসহায় শামসের মনের অবস্হা। এ দোটানা পাঠক মনকে দ্বিধায় ফেলবে। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। কখনো গাদ্দারের লাশ, কখনো ভাই হেলালের লাশ, কখনো নিজের লাশ। আসলে লাশটা কার! বুঝতে হলে পড়তে হবে সংক্রান্তি।

সংক্রান্তির মত এই উপন্যাসে রয়েছে আরো কতগুলো ভাগ। জন্মদিন, দাবানল, শরণ, বৈঠা, মুক্তি, গুলতি, ঘুম, যুদ্ধ সর্বশেষ বিজয়। এই ভাগ গুলো প্রত্যেকটাই সমৃদ্ধ। প্রত্যেকটাই সমানভাবে পাঠককে বুঁদ করে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।

এর কারণ হিসেবে যদি উপন্যাসের একটা অংশ "শরণ" নামক গল্পটুকু বিশ্লেষণ করি তবে দেখা যাবে বেগম নামে এক মহিলার বর্ণনা দিয়ে শুরু। রয়েছে বেগমের যন্ত্রণা, হতাশা। রয়েছে যুদ্ধের কথা। রয়েছে গুলতু নামের এক বালকের বর্ণনা। যার হাসির ব্যারাম। ব্যারামের জন্য তাবিজ.....পুঁটিমাছ, নীলক্ষেত, রিকশা, জীপ আবার সেই যন্ত্রণা। অর্থাৎ এত সাধারণ কোন মহিলার দুঃখ হতাশা তার মাঝে একটা যুদ্ধের ঘটনা। তার ওপর ঘটনা কোন গ্রামের নয়। বর্ণনা মহানগরীর বিখ্যাত নীলক্ষেতের। সবমিলিয়ে একটা ঘোরে পড়ে যেতে হয় পাঠককে। কখনো আপনি বুঁদ হবেন যুদ্ধের ময়দানে কোন এক শিশুর বর্ণনায়। দেশ স্বাধীন হবে, মানুষ জীবন দিচ্ছে, কে কোথায় হারাচ্ছে, মরছে এসব কিছু ভাবাবে না। অনুভব করবেন ওই যুদ্ধের প্রান্তরে একটা শিশুর মনের অবস্হা। ভাববেন শিশুটির কি হবে। এই শতশত মানুষের ভীড়ে এই একটি শিশুর বর্ণনা যুদ্ধের সমগ্র বর্ণনার প্রতিচ্ছবি। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। যুদ্ধের ভয়াবহতাটা সত্যিই এত সাধারণ ঘটনার মধ্যেও অস্বাভাবিক করুণ। "বৈঠা" অংশটুকু এমনভাবে বর্ণিত যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে সব। কখনো শিহরিত হচ্ছি, কখনো রক্ত গরম হচ্ছে, কখনো দৌড়াচ্ছি, কখনো চোখের সামনে সবুজ রংয়ের একটা সাপ। ঘটনাগুলো সব এমন ভাবে আষ্টেপিষ্টে ধরবে যেন এর থেকে মুক্তি নেই কারো। একটা যুদ্ধের ভয়বহতা এত সাধারণ কোন বর্ণনার ছলে প্রকাশ হতে পারে! আপনাকে উপন্যাসটি পড়তে হবে থেমে থেমে। বুঝতে হবে কেন একজন পাকিস্তানি মিলিটারীর বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু হলো।

একবার দম ফেলে ভাবতে হবে ওই নয় মাসের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া শিশুটির কথা। মুগ্ধতায় ভিজতে হবে। কিন্তু, অতৃপ্তি থেকে যাবে যদি শেষ অংশটুকুতে মনোযোগী না হন। উপন্যাসের শেষ "বিজয়" শিরোনামে একটি গ্রামের বর্ণনা দিয়ে। আপনাকে এক নিঃশ্বাসে পড়ে যেতে হবে শেষ চার প্যারা। শেষ লাইন পড়ে হাঁপাবেন। কিন্তু, ততক্ষণে বিজয় হয়েছে। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি সাজানো কয়েকটি ছোট ছোট গল্পের সমন্বয়ে। প্রত্যেকটা গল্পের স্বকীয়তা আছে। খুব সাধারণ ঘটনাগুলো মনে দাগ কেটে যাবে যেটা যুদ্ধের সময়কে জীবন্ত করে। খুব সাধারণ ঘটনার বর্ণনায় পড়া খুব সাধারণ কথায় মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখিত অসাধারণ একটি উপন্যাস। যদিও উপন্যাসটি শব্দঘরের ঈদসংখ্যা ২০১৭ তে প্রকাশিত। তবে বই আকারে আসছে এবারের বইমেলায়। সংগ্রহ করে রাখতে পারেন আপনার পছন্দের বইয়ের তালিকায়।

বইয়ের লেখক-আশান উজ জামান।তিনি ছোটগল্পকার, গীতিকবি। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বইটির পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ তে।

সুমাইয়া সীমা: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর