কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট : ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে আসন্ন তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের মাওলানা সা’দকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের মুরুব্বীদের একাংশ ও কওমীপন্থী আলেমরা।

শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় মাওলানা সা’দকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামোতের মধ্যে চলমান সংকট নিরসনে আয়োজিত এক পরামর্শ সভায় এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এ নিয়ে বৈঠক করছেন তাবলীগ ও কওমি আলেমরা।

এর আগে গতবছরের শেষের দিকেও তাবলীগের দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের মাওলানা সাদ কান্ধলভী’র বাংলাদেশে আসা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাওলানা সাদ’কে ঠেকাতে মাঠে নেমেছে হেফাজতে ইসলামসহ কওমি আলেমরাও। আর এসব দ্বন্দ্বে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে গত ১৪ নভেম্বর হাতাহাতি ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

তাবলীগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ব জুড়ে নিরপেক্ষ ধর্মীয় প্রচারের তাবলীগ জামাতের মারকায (মূলকেন্দ্র) ভারতে দিল্লির নিজামুদ্দিনতে,যা নিজামুদ্দিন মারকায নামে পরিচিত৷ সেই মারকাযের অন্যতম ব্যক্তি মাওলানা সা’দ কান্ধলভী৷ বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ভারতসহ সারাবিশ্বের কওমি মাদ্রসা শিক্ষার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দ চিঠি দিয়ে নিজামুদ্দিন মারকাযে প্রতিবাদ জানায়।

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানিসহ শীর্ষ আলেমরা বিবৃতি দিয়ে মাওলানা সাদের বক্তব্য প্রত্যাহারের আহবান জানান। সে সময়ে চাপে পড়ে মাওলানা সা’দ তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। মাওলানা সা’দ আলেমদের অর্থের বিনিময়ে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার বিরোধিতা করে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি ক্যামেরা যুক্ত মোবাইল পকেটে রেখে নামাজ হয় না সহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করেন, যা সমালোচিত হয়।

তাবলীগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ২৯ অক্টোবর তাবলীগ জামাতের চলমান সংকট ইস্যুতে উলামা-মাশায়েখ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দারুল উলূম দেওবন্দ কর্তৃক মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে এবং ভারতে বিভক্ত দু’টি গ্রুপ একসাথে বিশ্ব ইজতিমায় আসতে পারবেন। দিল্লীর নিজামুদ্দীনে বিভক্ত গ্রুপের মধ্যে ঐক্য ছাড়া কোনো এক পক্ষ বিশ্ব ইজতিমায় শরীক হতে বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। ১৬ নভেম্বর তাবলীগ জামাতের অস্থিরতা নিরসনে কাকরাইল মারকাযের শুরার ১০ সদস্য এবং কওমি আলেমদের ৫ জন প্রতিনিধি পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সংকট নিরসনে ৫টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ৫ জন কওমি আলেমকে তাবলীগ জামাতের পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে মনোনিত করা হয়।

সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ থেকে আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর দারুল উলূম দেওবন্দ ও নিজামুদ্দীন সফর করেন। প্রতিনিধি দলটি ফিরে আসার পর স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় বৈঠকের আগে পরামর্শের জন্য উত্তরায় শনিবার (৬ জানুয়ারি) এ সভার আয়োজন হয়।

শনিবার উত্তরায় দেশের বিভিন্ন স্থানের কওমি আলেম ও তাবলীগের সহস্রাধিক সাথী উপস্থিত ছিলেন। মুফতী মাসউদুল কারীম-এর সভাপতিত্বে পরামর্শ সভায় বক্তব্য রাখেন, কওমীপন্থী আলেম ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী,বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস,মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, হেফাজত নেতা মাওলানা জুনায়েদ আল-হাবীব, মুফতী কিফায়াতুল্লাহ,মিজানুর রহমান, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল কদ্দুস,মাওলানা শিব্বির আহমদ, হেফাজত আমিরের পুত্র মাওলানা আনাস মাদানী,মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী,মাওলানা হাফেজ নাজমুল হাসান, মুফতী কিফায়াতুল্লাহ আযহারী,তাবলীগের সাথী ড. আজগর আলী, মাওলানা রাইয়ান, মাওলানা শামীম ওসমান, মুফতি আব্দুল মুকিত, মাওলান আনিসুর রহমান প্রমুখ।

সভায় হেফাজত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী’র পক্ষে তার লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মাওলানা আনাস মাদানী। লিখিত বক্তব্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, মাওলানা সা’দ সাহেবের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে যে কোন শর্তেই হোক না কেন- যদি বিশ্ব ইজতিমায় আসার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দ্বীনি কাজের যেমন বিশাল ক্ষতি হবে, তেমনিভাবে দেশের শান্ত পরিবেশও বিনষ্ট হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা তৈরি হবে। তাই জাতির কর্ণধার উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের প্রতি আহবান, আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী এই মুবারক মেহনতের সুরক্ষায় শান্তিপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

সভায় ২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১. ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের অনাস্থা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মাওলানা সা’দের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন। ২. আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের মাওলানা সা’দ ও মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা উভয় গ্রুপ এক সঙ্গে আসতে হবে। কোন এক গ্রুপ একক ভাবে আসতে বাংলাদেশে আসতে পারবেন না।

সভা প্রসঙ্গে তালীগের সাথী শাহরিয়ার মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, শুধু মাত্র মাওলানা সা’দের জন্য তাবলীগের মতো বিশাল এক দ্বীনি খিদমতকে কোনভাবেই কলুষিত করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে বাংলাদেশের সমগ্র আলেম সমাজ দৃঢ়ভাবে একমত পোষণ করে সজাগ ও সতর্ক আছেন। যে কোন ধরনের উস্কানিমূলক অপতৎপরতা প্রতিহত করে দিতেও তৌহিদী জনতা পিছপা হবে না।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/জানুয়ারি ০৬, ২০১৮)