শুভজ্যোতি ঘোষ

বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের যখন আর মাত্র কয়েক মাস বাকি, তখন সে দেশের মন্ত্রী, নীতিনির্ধারক বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হঠাৎ করে খুব ঘন ঘন দিল্লি যাতায়াত শুরু করেছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-এই দুই প্রধান দলের নেতারাই সম্প্রতি ভারতে এসে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন, মতবিনিময় করছেন নানা থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গেও।

বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা আছে যে সে দেশের নির্বাচনে ভারত সব সময় একটা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে-কিন্তু বাস্তবেও কি ঘটনাটা তাই?

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমারকে যখন মাত্র দিনচারেক আগে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তিনি স্পষ্টভাবে তা নাকচ করে দিয়েছিলেন।

তিনি সেদিন বলেছিলেন, "বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যে কোনও দেশে নির্বাচন হোক না কেন সেটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ব্যাপার-সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাক গলানোর কথা ভারত কখনও স্বপ্নেও ভাবে না। ঘরের পাশে বাংলাদেশের জন্যও একই কথা খাটে।"

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই প্রধান দলই যেভাবে দিল্লির সমর্থন আদায়ের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশে এই ধারণাটাই জোরালো হচ্ছে সে দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভারতের একটা ভূমিকা অবশ্যই আছে।

ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী এটাকে নাক গলানো বলতে রাজি নন-তবে তিনি মনে করেন ভারত অবশ্যই ঢাকাতে নিজেদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।

"প্রভাব যদি বলেন তাহলে এটুকু অবশ্যই বলব কোন সরকার সে দেশে ক্ষমতায় আসলে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব বাড়বে সেই বিবেচনায় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হয়তো থাকে। কোন সরকার এলে আমাদের সুবিধে হবে, আমাদের প্রোজেক্টগুলো ঠিকমতো চলবে এটা অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর থাকে।"

"আর সেই দিক থেকে দেখলে যদি আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-র মধ্যে তুলনা করে একটা ব্যালান্স শিট তৈরি করা হয়, তাহলে কোনও সন্দেহ নেই যে আওয়ামী লীগের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সদ্ভাব বাড়ে, কাজও ভাল হয়। অন্য দিকে বিএনপি-র একটা ভারত-বিরোধী দৃষ্টিকোণ এখনও আছে, আর পাকিস্তানপন্থী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে তাদের আঁতাতও আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা", বলছিলেন সাবেক ওই কূটনীতিক।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এইচ টি ইমাম এ সপ্তাহেই দিল্লিতে আসছেন ভারত সরকারের সংস্থা আইসিসিআরের প্রধান ড: বিনয় সহস্রবুদ্ধের আমন্ত্রণে।

ক্ষমতাসীন বিজেপির এই সহ-সভাপতি তথা এমপি বিবিসিকে বলছিলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ভারতের সঙ্গে কেন সুসম্পর্ক চাইছে তার কারণ বোঝা শক্ত নয়।

বিজেপির এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন, "নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার যে আন্তরিকতা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছেন, তাতে শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকরা নন - সে দেশের মানুষজনরাও মুগ্ধ। ফলে এটা স্পষ্ট যে সে দেশের ভোটাররাও এমন দলকেই ক্ষমতায় দেখতে চান, যারা ভারতের সঙ্গে একটা প্রাণবন্ত সম্পর্ক গড়ে তুলবে।"

অর্থাৎ বিজেপি মনে করছে, ভারত-বিরোধিতা নয়-বরং ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কই এখন বাংলাদেশের দলগুলোকে নির্বাচনী ফায়দা দেবে এই ধারণা থেকেই দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বিএনপি এটাও বিশ্বাস করে যে ভারতের জোরালো সমর্থনের সুবাদেই শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারছে।

যদিও পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন, সেটাই হাসিনার সরকারের টিকে যাওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে না।

তার কথায়, "হ্যাঁ, ভারত শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছে ঠিকই, কিন্তু তার সরকারের একটা জোরালো সাংবিধানিক বৈধতা ছিল এটাও মনে রাখতে হবে। কেউ একটা নির্বাচন বয়কট করলেই সেটা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যেতে পারে না।"

পছন্দের সরকারকে সমর্থন দিলেও ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেও হস্তক্ষেপ করে থাকে বলে বাংলাদেশে যে প্রচার আছে, তাকে অবশ্য মোটেই আমল দিতে রাজি নন তিনি।

"প্রচার তো ওখানে অনেকেই অনেক কিছু করে, তা তো আর আমরা রুখতে পারব না। কিন্তু আমি যতদূর জানি ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে কখনও সরাসরি কোনও হস্তক্ষেপ করেনি। প্রভাব খাটানো বলতে ভারত হয়তো বড়জোর নিজের পছন্দের সরকারকে চেয়েছে - যাতে কোনও অন্যায় নেই। দুনিয়ার সব দেশই তাই করে, আর সেটা আন্তর্জাতিক রাজনীতিরই অংশ", বলছিলেন মি চক্রবর্তী।

অর্থাৎ ভারতের পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস-বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভারতের যেটুকু প্রভাব তা মনস্তাত্ত্বিক বা কূটনৈতিক, সেখানে পছন্দের দলকে ভোটে জিততে সাহায্য করবে আগ বাড়িয়ে এমন কোনও পদক্ষেপ ভারত নেয়নি বা নেবে না।

সূত্র:বিবিসি বাংলা

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুলাই ০৪,২০১৮)