মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, দ্য রিপোর্ট : কবি নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে উচ্চারণ করেছিলেন-

‘কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে-
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!”

আরবার জন্ম নিয়ে বিদ্রোহী কবির আকাঙ্ক্ষা ছিল রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গীতে অবগাহনের।

হ্যাঁ, আজ ২২ শে শ্রাবণ। সাতাত্তর বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি। অসামান্য রচনা ও সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি আজো বেঁচে আছেন সবার মণিকোঠায়।

তিনি বাংলাভাষাভাষী মানুষের প্রেরণার এক অন্তহীন উৎস। কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি এবং এশীয় হিসেবে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল এনেছিলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, নাট্যকার, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন কোনো দিক নেই যেখানে এই কীর্তিমানের ছোঁয়া পড়েনি। আশি বছরের জীবন সাধনায় বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করে গেছেন তিনি। কবিতা দিয়ে সাহিত্যচর্চার শুরু এবং শেষ হলেও তার হাতেই বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ছোট গল্পের সৃষ্টি হয়েছে। তিনিই আবার বাংলা উপন্যাসকে আধুনিক রূপ দেন। শুধু সৃজনশীল সাহিত্য রচনা নয়, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে তার ভাবনাও তাকে সম্মানের আসনে পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষের মুক্তির দর্শন ছিল তার চেতনাজুড়ে। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র কবি যিনি দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর তার রচিত 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। তারই 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে' গানটি ভারতের জাতীয় সংগীত। প্রয়াণ দিবসে আজ দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষা-ভাষীরা বিশ্বকবিকে স্মরণ করছে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়।

বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮, ৭ আগস্ট ১৯৪১, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে। সেদিনই সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-‘রবি আজ ডুবে গেল। এ রবি আর উঠবে না। কেবল কি বাংলা আজ আঁধার হয়েছে? না, সারা ভারত, সারা ভারত কেন, সারা বিশ্ব আজ আঁধার। আধুনিক ভারত নয়, মধ্যযুগের ভারত নয়, প্রাচীন ভারত নয়, সমগ্র শ্রেষ্ঠ অবদান, রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের সেদিনের কথা এখনও মনে আছে, যেদিন রবীন্দ্রনাথ কেবল নোবেল পুরস্কার লাভ করে জগতকে বিস্ময়বিমুগ্ধ করেছিলেন। সভ্যতার প্রাচীন জননী এসিয়াভূমির কথা নবীন ইউরোপ, এমেরিকা ভুলে গিয়েছিল। এসিয়ান সন্তান রবীন্দ্রাথ তাদের অনিচ্ছুক দৃষ্টিকে আবার এসিয়ার দিকে তথা ভারতের দিকে কোন মন্ত্রবলে যেন ফিরিয়ে এনেছিলেন। এ বিস্ময় কি কম বিস্ময়?

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভিতরে-বাইরে সুন্দর। তার আকৃতি সুন্দর, মন সুন্দর, আত্মা সুন্দর। তাই তিনি এত বড় সৌন্দর্য্যরে কবি হতে পেরেছিলেন। জগতের যা কিছু সৌন্দর্য্য তার কাছে নিবিড়ভাবে ধরা দিয়েছিল। কুৎসিতের মধ্যে, পাপের মধ্যেও তিনি সৌন্দর্য্যরে ছবি দেখেছিলেন।’

তিনি তার ভাষণে আরো বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ অমর কবি, তিনি অমরধামে গিয়েছেন। মরণ কখনো তাঁর কাছে ভয়ানক ছিল না। পরম বন্ধুর মত তিনি ভানুসিংহ ঠাকুরের ভনিতায় মরণকে সম্বোধন করে বলেছিলেন -

“মরণ রে তুঁ হুঁ মম শ্যাম সমান”

যৌবনেও তিনি তাঁরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। নিজের অন্তিম ছবিখানি তিনি কি নিপুণভাবে নিজেই এঁকে দিয়েছেন-

‘একদা নামিয়ে সন্ধ্যা বাজিবে আরতি শঙ্খ
অদূরে মন্দিরে,
বিহঙ্গ নীরবে হবে উঠিবে ঝিল্লীর ধ্বনি
অরণ্যে গম্ভীরে
সমাপ্ত হইবে কর্ম্ম সংসার সংগ্রাম শেষ
জয় পরাজয়
আসিবে তন্দ্রার ঘোর পান্থের নয়ন পরে
ক্লান্ত অতিশয়।
তবে যাও কবি অমর ধামে, যেখানে পূর্ণ সৌন্দর্য্য, পূর্ণ আনন্দ, পূর্ণ প্রেম নিত্য বিরাজ করে সেই শাশ্বত ধামে।

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র এ মূল্যায়ণ আজ ৭৭ বছর পরে এসেও একই রকম শাশ্বত মনে হয়। যত দিন যাচ্ছে তত রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলের কাছে নতুনভাবে বহুমাত্রিকতায় আবিষ্কৃত হচ্ছেন। তাই প্রতিবছর বাঙালি নানা আয়োজনে তাকে স্মরণ করেন। প্রণতি জানায় বারবার। গুরুজির সৌন্দস্য সৃষ্টিতে অভিভূত হয়ে একদিন এমনই নিবেদন রেখেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-

‘অন্তরে হের হারানো রবির জ্যোতি

সেইখানে তাঁর নিত্য কর প্রণতি।’

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ০৫, ২০১৮)