সম্প্রতি ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ ছাত্রের মৃত্যুর বেদনাদায়ক ঘটনার খবর শুনে আমার শৈশবের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল, যার সঙ্গে বর্তমানের বহুল আলোচিত ঘটনার মিল রয়েছে।আশা করি বন্ধুরা গল্পটি পড়বেন।

অনেকদিন আগের ঘটনা, স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে।
আশির দশকের গোড়ার কথা। আমি তখন রংপুর শহরের পূর্ব-গুপ্তপাড়ায় আমাদের বাসায় থাকি, সবেমাত্র কারমাইকেল কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি । শান্ত-স্নিগ্ধ ছিম ছাম রংপুর শহর। গাছগাছালিতে ভরা সবুজ চারিদিকে। শহরের এক প্রান্তের মানুষ আর এক প্রান্তের মানুষকে চিনতো, সকলের মধ্যে একটা কোমল, সহজ সরল সম্পর্ক ছিল। আমরা বয়স্ক লোকদের চাচা, চাচি বলতাম; আংকেল, আন্টি বলতামনা। পাড়ায় পাড়ায় মাঝে মাঝে ছোটখাটো মারামারি হত, তবে বন্দুকবাজি, বোমাবাজি হতোনা। প্রধান সড়ক বাদে অধিকাংশ রাস্তাই ছিল কাচা ও সরু। রাস্তার ধুলো আর কাদা মেখে সারা শহর ঘুরে বেড়াই। আমার একটা সিলভার রঙের বাইসাইকেল ছিল। ওটাতে চড়ে সারা শহর ভবঘুরের মত অবিরাম ঘুরতাম,বন্ধুদের সঙ্গে হৈহৈ করে, নানা জায়গায় আড্ডা মেরে দিনগুলো কাটতো।

কুয়াশাচ্ছন্ন এক শিতের সকাল। আমি আমার সাইকেলে চড়ে কারমাইকেল কলেজে যাচ্ছি। ঠিকাদার পাড়ার রোড থেকে কলেজ রোডে উঠতে যাব, এমন সময় আমার সহপাঠি জামাল ওর সাইকেলে কলেজ রোড ধরে আমাকে অতিক্রম করে গেল। একে অপরের উদ্দেশ্যে হাত উঁচিয়ে আমরা আগে পিছে কলেজের দিকে যেতে লাগলাম। কলেজ রোডে পানির ট্যাঙ্কের নিচে শহরের কেন্দ্রিয় বাস স্ট্যান্ড ছিল। নাম ছিল বগুড়া বাস স্ট্যান্ড। তখন রংপুরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই কলেজ রোড। উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের বুক চিরে চলে গেছে এই কলেজ রোড। শহরের আরকে বাইপাস রোড অনেক পরে তৈরি হিয়েছে। বাস স্ত্যান্ড থেকে লালবাগ রেল লাইন পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম দিকে ছিল শুধু ধানী জমি। রাস্তার পূর্বপাশ ধরে কিছু বাড়িঘর ছিল, তবে এখনকার মত সারি সারি গা ঘেঁষে থাকা বাড়িঘর ছিল না। যাই হোক, স্বভাবতই এখানে যানবাহন চলাচল ছিল বেশি। তাই একটু সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছি। আমার সামনে একটু দূরে জামালের সাইকেল দেখা যায়। মুরগির ফার্মের কাছা কাছি এসে দেখতে পেলাম, ফার্মের প্রধান গেটের সামনে একটা খালি ট্রাক এক সাইকেল আরোহিকে চাপা দিয়ে দ্রুত লালবাগের দিকে চলে গেল। আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল, কেমন একটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল মন এই ভেবে, দুর্ভাগা আরোহী জামাল কিনা? আমার সাইকেলটা রাস্তার পাশে রেখে কাছে গিয়ে দেখি জামালের নিথর দেহ রাস্তার এক পাশে পড়ে রয়েছে, শরীরের উপরের অংশ থেঁতলে গেছে, মুখ থেকে সামান্য রক্ত ও লালা বের হয়েছে। ভাল করে দেখলাম ও তখনো আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে। আশেপাশে থাকা লোকজন ও কলেজগামি ছাত্ররা জড় হয়ে গেছে।তখন অনেকেই সাইকেলে করে কলেজে যাতায়াত করতো। যাই হোক, ওকে দ্রুত একটা রিক্সায় করে নিকটস্থ আবহাওয়া অফিস মোড়ে এক ডাক্তারের চেম্বারে নেয়া হল। ডাক্তার ওকে দেখে বললেন, তাড়াতাড়ি মেডিকেলে নিয়ে যান।তখন রাস্তায় একটা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে সেই গাড়িতে করে ওকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মৃত্যুর হীমশীতল হাওয়া ওর কিশোর জীবন প্রদীপ দপ করে নিভে দিয়েছে। এম্বুলেন্সে করে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া গেলে হয়তো ওকে প্রাণে বাঁচানো যেত। তখন মোবাইল ফোন ছিলনা, হাসপাতালে দু একটা এম্বুলেন্স ছিল।

জামালের মৃত্যুর খবর কলেজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, উত্তপ্ত হয়ে পড়ল কারমাইকেল কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাস। শত শত ছাত্র-ছাত্রীর এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হল জেলা প্রশাসক অফিস ঘেরাও করতে।ছাত্রদের মুল দাবি ছিল ঘাতক ট্রাক ড্রাইভারকে গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদান করা এবং কলেজ রোড থেকে অবিলম্বে বাস স্ট্যান্ড অন্যত্র সরিয়ে নেয়া। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন বিখ্যাত ছাত্রনেতা প্রয়াত সোহরাব হোসেন, আলাউদ্দিন, রাজ্জাক, রকিবুস সুলতান মানিক সাহসী ভুমিকা রেখে শান্তিপূর্ণ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যাহোক, ডিসি অফিসে যাওয়ার পর দেখা গেল ডিসি অফিসে নেই। মিছিল থেকে তখন কেউ কেউ অফিসের দরজা জানালা লক্ষ্ করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলো। ছাত্রনেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান রাস্তা ধরে কলেজে ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডে একদল পরিবহন শ্রমিক লাঠি সোটা নিয়ে আমাদের উপর হামলা করে। অতর্কিত হামলায় আমাদের মিছিল তেঁতুল তলার দিকে পিছিয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে অনেকে আশেপাশের সরু গলিতে ঢুকে পড়ি। উভয় পক্ষে ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্ররা একত্রিত হয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের ধাওয়া করে ওদের পিছু হটায়। শ্রমিকদের তুমুল ইট পাটকেল বর্ষণের মধ্যেও সেদিন সোহরাব ভাই একটা ভাঙ্গা লাঠি হাতে একাই অনেকদুর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এটা দেখে ছাত্ররা শ্রমিকদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। যাক অবশেষে আমরা কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছই। বেশ কিছু ছাত্র সামান্য আহত হয়েছিল। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় আমার সাইকেলটি হারিয়ে যায়।

জামাল বেগম রোকেয়া কলেজের কাছে তার বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশুনা করতো। ওর গ্রামের বাড়ি ছিল শঠিবাড়িতে। পরের দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনারে একটি শোকসভার আয়োজন করে। রংপুর সদর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত রেজাউল হক সরকার রানা এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও জামালের সহপাঠি হওয়ায় শোকসভায় আমাকেও বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। জামাল হত্যার ব্যাপারে ছাত্রদের দাবী দাওয়ার কোন কিনারা কখনো হয় নাই।

জীবনে প্রথম এত কাছ থেকে দেখা একজন বন্ধু-সহপাঠির অকাল মৃত্যু-শোক এ অনেকদিন অশান্তিতে কেটেছে। তারপর থেকে যখনই আমি ওই পথ দিয়ে গেছি, যতবার ঐ জায়গায় আমার চোখ পড়েছে, ততবার আমার বুক কেঁপে উঠেছে। আজ এতোটা বছর পার করে এসেও সেটা এতটুকু কমেনি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কানাডা প্রবাসী

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ০৭,২০১৮)