দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও বিচারের পথ খুলেছে।

আইসিসির ‘প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১’ বৃহস্পতিবার রাতে এক যুগান্তকারী রায়ে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করে বাংলাদেশে পাঠানোসহ অন্যান্য অভিযোগ আইসিসি তদন্ত করতে পারবে। ওই রায়েই আইসিসি তার প্রসিকিউটরকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এর ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ সব অপরাধের ন্যায়বিচারের সুযোগ সৃষ্টি হলো। আদালত সরাসরি গণহত্যা বা যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধের কথা উল্লেখ না করলেও আইসিসির রোম সংবিধির আওতায় বর্ণিত সব অপরাধ তদন্তের সুযোগ গত রাতের রায়ে দিয়েছেন।

বিচারক পিটার কোভাক্স, মার্ক পেরিন ডি ব্রিচামবুট ও রেনি অ্যাডিলেড সোফি অ্যালপিনি-গ্যানসুর সমন্বয়ে গঠিত আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ওই রায় দেন। বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য হলেও মিয়ানমার নয়। মিয়ানমার থেকে উৎখাত হয়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রেক্ষাপট আইসিসি তদন্ত করতে পারে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে গত এপ্রিল মাসে আইসিসির প্রসিকিউটর ফেতু বেনসুদা আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ অ্যামিকাস কিউরি ও প্রসিকিউটদের অভিমত ও ‘স্ট্যাটাস কনফারেন্স’ (শুনানি) শেষে আইসিসি গত রাতে ওই রায় দেন।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ আইসিসিকে তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, এ দেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর আদালতের পূর্ণ এখতিয়ার আছে। গত রাতে আদালতের রায়েও এমন পর্যবেক্ষণ দেখা গেছে।

আইসিসির প্রি[-ট্রায়াল চেম্বার-১ পর্যবেক্ষণে দেখতে পেয়েছে, আইসিসির প্রসিকিউটর ফেতু বেনসুদার ওই আবেদন আন্তর্জাতিক আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি ‘লা কম্পিটেন্স ডি লা কম্পিটেন্স’-এর সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ। ওই নীতির আওতায় কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তাঁর নিজস্ব বিচারিক এখতিয়ার নির্ধারণ করতে পারেন।

আদালত পর্যবেক্ষণে আরো বলেছেন, মিয়ানমার আইসিসিবিষয়ক সংবিধির পক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও আদালতের আন্তর্জাতিক আইনি উদ্দেশ্য আছে। সংবিধি অনুযায়ীই আদালতের এখতিয়ার নির্ধারিত হবে।

প্রসিকিউটরের মূল অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১-এর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, প্রথমত, আইসিসির ৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদে দুটি আলাদা অপরাধ হিসেবে ‘জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি’ ও ‘বহিষ্কারের’ কথা উল্লেখ আছে। দ্বিতীয়ত আইসিসি সংবিধির ১২(২)(ক) অনুচ্ছেদের আওতায় এর সদস্য কোনো রাষ্ট্রে যদি আইসিসি সংবিধির পঞ্চম অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধ বা সেই অপরাধের কোনো অংশ সংঘটিত হয় তবে আইসিসি সেখানে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কারের মাধ্যমে তাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অভিযোগে আইসিসির তদন্ত করার এখতিয়ার আছে বলে চেম্বার আদালত রায় দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে চেম্বার আদালত বলেছেন, ওই অপরাধের একটি অংশ (সীমান্ত পাড়ি দেওয়া) সংঘটিত হয়েছে এমন একটি ভূখণ্ডে যেটি (বাংলাদেশ) আইসিসির রোম সংবিধির পক্ষ।

আদালত আরো বলেছেন, আইসিসি তার সংবিধির পঞ্চম অনুচ্ছেদে বর্ণিত অন্য যেকোনো অপরাধ যেমন নিপীড়ন বা অন্য যেকোনো অমানবিক আচরণের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

চেম্বার আদালত আরো বলেছেন, প্রসিকিউটর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত অপরাধের প্রাথমিক তদন্ত চালিয়ে যাবেন এবং অবশ্যই আদালতের এই নির্দেশনা বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করবেন। এ প্রেক্ষাপটে আদালত আরো বলেছেন, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত অবশ্যই শেষ করতে হবে।

বিচারক মার্ক পেরিন ডি ব্রিচামবুট প্রক্রিয়াগত বিষয়ে এই রায়ের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, ‘লা কম্পিটেন্স ডি লা কম্পিটেন্স’ নীতির আলোকে চেম্বার আদালত রায় দিতে পারেন না। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বহিষ্কারের অভিযোগের এই পর্যায়ে আদালত তার নিজের এখতিয়ার নির্ধারণ করতে পারেন না। তবে প্রসিকিউটর সংবিধির পঞ্চদশ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তদন্তের অনুমতি চেয়ে প্রি-ট্রায়াল চেম্বারে আবেদন করতে পারেন।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে প্রসিকিউটরকে তদন্ত চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউটর গত এপ্রিল মাসে তাঁর আবেদনে আইসিসিকে বলেছিলেন, তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করতে পারতেন। কিন্তু তদন্তের জন্য বরাদ্দ সীমিত সম্পদ তিনি নষ্ট করতে চান না। এ কারণে আইসিসির এখতিয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তিনি তদন্তে নামতে চান।

গত ২৭ আগস্ট জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দল মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ ছয় সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ তদন্তে কাঠামো সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। ওই দলটির প্রতিবেদন আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে ওঠার কথা। এর আগেই গত রাতে আইসিসির তদন্তের সুযোগ সৃষ্টি করল।

অন্যদিকে মিয়ানমার দাবি করে আসছে, তারা আইসিসির সদস্য নয় বলে বিচারের সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্তে অপরাধ প্রমাণ হলে মিয়ানমারের বিচার থেকে রেহাই নেই।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৮)