আতোয়ার রহমান

ওস্তাদ, জোরে বাড়েন, পিছে মুড়ির টিন। ডাইনে কেটে বামে বাড়েন। পাগলা টান হবে ওস্তাদ।লিক্ লিকে চেহারা বয়স বিশের কিশোর বাস হেলপার  সুমন ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল। অল্প বয়সী ড্রাইভার, মামুন নাম। মুখ থেকে সস্তা পান মশলার গন্ধ বের হচ্ছে।আজ সকালে আকন্ঠ মদ গিলে এসেছে। গাজিপুর থেকে ছেড়েই বেপরোয়া চালাচ্ছে নুর এ তাজ পরিবহণের গাড়িটি। ফার্মের ষাঁড়কে ইনজেকশন দিলে যেমন উন্মত্তের মত লাফায়, সেরকম লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়িটি চলছে। ট্রাক, বাস,  মফস্বল থেকে ছেড়ে আসা নাইট কোচগুলোকে ওভারটেক করে যাচ্ছে। বাসের হেলপারটা দরজায় ঝুলে ঝুলে চিৎকার করে স্ট্যান্ডের নাম হাঁকছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে যাত্রীরা উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। কোনমতে তাল সাম লাতে পারছেনা। যাত্রীদের বুক ধুকধুকুনি বেড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ খোদার নাম নিতে থাকল। ভালোয় ভালোয় জান নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়।

ড্রাইভার একটু ঘাড় ফিরে পেছনে তাকিয়ে দেখে মায়ের দোয়া পরিবহনের গাড়িটি প্রায় তার গা ঘেঁষে চলে এসেছে। আর একটু হলেই তাকে ওভারটেক করবে। তার মাথায় আগুন ধরে গেল। মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে। সামনে ফুটপাথে দাঁড়ানো যাত্রীগুলোকে সে হয়তো তার গাড়িতে নিতে পারবেনা। গত মাসের মত এমাসেও মালিকের কন্ট্রাক্টের টাকাটা পুরো পরিশোধ করতে পারবেনা। তার ও হেলপারের কিভাবে চলবে এ মাস? চোখ বন্ধ করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পা দিয়ে আক্সেলটরে সজোরে চাপ দিয়ে ডান দিকে ঘুরে রাস্তা বন্ধ করে দিল যাতে মায়ের দোয়া পরিবহনের গাড়িটি তার গাড়িকে ওভারটেক করতে না পারে। পানের ছোপ ধরা দাঁত বের করে মুখ ভ্যাংচে পাশের গাড়ির ড্রাইভারের গোষ্ঠী উদ্বার করল। স্পিড আচমকা বাড়িয়ে দিল।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস উঠে গেল পাশের ফুটপাথে। ক্লান্ত শরীরে পেছনে স্কুল ব্যাগ পরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কলেজ ছাত্র দিয়া ও করিমকে একরকম পিষে ফেলে কিছুদূর এগিয়ে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেল। দ্রুত গতির কারণে ডিগবাজি খেতে খেতে এগুতে লাগল। বাসের ভেতরের যাত্রীগুলো বোতলে রাখা ওষুধ রোগীরা খাওয়ার আগে যেভাবে ঝাঁকায়, ঠিক সেরকম ঝাঁকুনি খেল। ক্যাচ করে ব্রেক কষে অবশেষে দ্বিতীয় ওভারব্রিজের পিলারে লেগে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। ড্রাইভার প্রাণপনে চেষ্টা করেও আর চলমান করতে পারলনা যন্ত্রদানবকে। শুধু বার কয়েক অন্তিম আর্তনাদ করে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে থেমে গেল সে। একটা ভারি মেটাল সিম্ফনির মত প্রচন্ড আওয়াজ। বিকট চিৎকার আর সজোরে পড়ে যাওয়া। জড়ো হওয়া মানুষের প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে ড্রাইভার, হেল্পার মিশে গেল। দুমড়ানো মোচড়ানো বাসটাকে সালভাদোর ডালির আঁকা একটা শিল্পকর্ম মনে হচ্ছিল। রাস্তায় চারিদিকে সাদা কাঁচের টুকরো, ভাঙ্গা মোবাইল, লোহা লক্কড়, গলিত প্লাস্টিক, ছিন্নভিন্ন মানুষের হাত পা, স্কুল ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাস্তার মাঝখানে দুটো নিথর দেহ লম্বালম্বি পড়ে আছে।বিরাট আকাশের নিচে দুপুরের এই কোলাহলে এ হতভাগা যাত্রীগুলোকে মনে হচ্ছে সামান্য কীটপতঙ্গ, যার জন্ম হয়েছে কেবল মৃত্যুর জন্য, সড়কে মৃত্যুই যেন তাদের নিষ্ঠুর নিয়তি।

আশেপাশে থাকা লোকজন জড়ো হল। ভালোভাবে পরখ করে দেখল দুজনের নিথর নিস্তব্দ দেহ। মনে হল দেহে তখনো প্রাণ আছে। মুখ দিয়ে মৃদু গোঙানি বের হচ্ছে। কিন্তু লোকজনের সেদিকে খেয়াল নেই। কেউ কেউ সেলফি তোলায়, ভিডিও করায় ব্যস্ত, কেউ কেউ আবার দুর্ঘটনাটা কেমন করে ঘটল সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে আর তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত। একজন বয়স্ক লোক দিয়া, করিম সহ আরও দুজন গুরতর আহত যাত্রীকে একটা প্রাইভেট গাড়িতে করে দ্রুত হাস্পাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করল। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার ভালভাবে দেখে তাদের মৃত্যু ঘোষণা করল। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মৃত্যুর হিমশীতল হাওয়া ওদের কিশোর জীবন প্রদীপ দপ করে নিভে দিয়েছে চিরদিনের জন্য।মহতি শিক্ষকের শিক্ষার স্পর্ধিত আলোয় উদ্দীপ্ত আলোর শিখা হয়ে জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেল দুই তুমুল, উজ্জ্বল কিশোর।

হ্যালো স্যার

হ্যা বলো মামুন।কী হয়েছে তোমার? কী সমস্যা?

স্যার অ্যাকসিডেন্টহয়েছে, স্যার। কুর্মিটোলায় গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাথে উঠে গিয়েছিল। দুইজন ছাত্রের স্পট ডেথ হয়েছে। অনেক আহত হয়েছে। গাড়িটা পাবলিক পুড়িয়ে দিয়েছে, স্যার। আমরা কোন মতো জান নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি।

ঠিক আছে, আমি দেখছি। তোরা একটু সাবধানে থাকিস। আজ আর গাড়ি বের করিস না। আমাদের মিরপুর রুটের গাড়িও বন্ধ করে দিতে বল।

আচ্ছা।

শওকত চটজলদি সব নিউজ চ্যানেলগুলো দেখল। চ্যানেলগুলো এ দুর্ঘটনার সংবাদ ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করছে। সারা ঢাকায় তোলপাড় পড়ে গেছে। এয়ারপোর্ট রোডে ছাত্ররা গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। শওকত খুব শক্ত মনের মানুষ। সহজে কোনকিছুতে ঘাবড়ায়না। কিন্তু আজ ঘাবড়ে গেল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল।

হ্যালো কামরান ভাই,

হ্যা, বলো শওকত!কী হয়েছে তোমার? গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?

ভাই, আমার গাজীপুরের সাত নম্বর রুটের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে। আজ দুপুরে এয়ারপোর্ট রোডে হোটেল রেডিসনের কাছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে গাড়িটা। তাড়াতাড়ি নিউজ চ্যানেলটা অন করেন।দেখতে পাবেন। অ্যাঁ বলো কী? কয়জন মারা গেছে?

এখন পর্যন্ত দুই জনের কথা শোনা যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে। ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বলা যায়না।

আরে ছাড় তো! পরিস্থিতির কী হবে? সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না। আমি আছি না। রাস্তা ঘাটে এক্সিডেন্ট হবেনা তো কোথায় হবে?

শেষ কথাটা বলে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে শওকতের ফোন কেটে দিলেন কামরান। কী গো এত হাসছো কেন? হাসির আওয়াজ শুনে কামরানকে প্রশ্ন করলেন তার স্ত্রী শায়লা।

আরে তেমন কিছু না। টিভিটা অন করতো। শওকত বললো ওর বাসটা এয়ারপোর্ট রোডে এক্সিডেন্ট করেছে। দুইজন ছাত্র মারা গেছে।

বলো কী? এতোগুলো মানুষ মারা গেছে আর তুমি হাসছ?

হাসবনা গিন্নি? ঘরে লক্ষী আসবে যে।

মানে?

তাও বুঝলেনা এতদিন আমার সঙ্গে ঘর করে? এ ব্যাপারটা সামাল দেয়ার জন্য শওকতের কাছ থেকে আর কিছু মাল কামানো যাবে।

ছিঃ ছিঃ তোমাদের মত কিছু মানুষের লোভে বলী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

গিন্নি যাওতো, আমাকে লেকচার দিও না।

বাবা মায়ের বড় আদরের মেয়ে দিয়া।খুবই মেধাবি। বাবা, মা, ছোট ভাই আর সে। এই নিয়েই ওদের ছোট অভাবের সংসার। দারিদ্রের চোখে চোখ রেখে যুদ্ব করে স্কুলের সীমানা পেরিয়ে কলেজে এখন সে। সবে একাদশে ভর্তি হয়েছে। মা বাবার ইচ্ছা মেয়ে বড় হয়ে হবে ডাক্তার। সেই থেকে জীবনের সব ঝড়ঝাপ্টা সামলে দিয়াকে বড় করে তুলেছে তারা। নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও দিয়াকে সমস্ত সমস্যা, বিপদ থেকে আড়াল করে এসেছে।

বাবা বলতো, তোমাকে পরীর মত লাগছে মা, তখন বয়স কত ছয় কি সাত। সেই তখন থেকে দিয়া ভাবে তাকে হয়তো পরীর মতই লাগে সাজলে। মেয়েলি মনটি সেজে উঠতে চায় রোজ নতুন করে। আজও খুব সেজেগুজেই কলেজে এসেছিল দিয়া। কুড়িল বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘামে ভিজে আছে মুখ।দিয়া স্কুল ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে মুখটা আর গলার কাছটা একটু মুছে নিল। যা ভ্যাপ্সা গরম পড়েছে দিন কয়েক, বৃষ্টির দেখা নেই। আজ আবার রোদ ও উঠেছে তেমনি। প্রতিদিন ভীড় বাস ঠেলে কলেজে যাতায়াত করে দিয়া। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কিছুক্ষণ গেম খেলার পরে ফেসবুক খুলে দেখতে থাকে বন্ধুদের স্ট্যাটাস আপডেটস।একের পর এক বন্ধুদের ছবি। সকলেই শেয়ার করেছে তাদের জীবনের নানা খুশির মুহূর্ত। ভাল লাগে দিয়ার। লাইক, কমেন্ট দেয় পোস্টগুলোতে। খানিক এসব করছে, আর বাস আসার পথে তাকাচ্ছে।

কিরে মা শুনতে পাচ্ছিস? পাচ্ছি মা, বল।

তুই কখন আসবি? একটু বাসায় তাড়াতাড়ি আসতে পারবি মা? তোর জন্য আজ মাংস রান্না করেছি। দারুণ হয়েছে। দেরি করলে ওগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে। ঠিক আছে মা তাড়াতাড়ি আসতেছি। আমি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। মা বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে খাবারের থালা নিয়ে। আলুর ভর্তা, মুরগীর মাংস, গরম ভাত, মেয়ের পছন্দসই সমস্ত কিছু আছে। মেয়েটা কোনদিন একটু টিফিন খেতে পায়না।স্কুলে যাওয়ার আগে আজ ভাত সাথে ওর বাবার জন্য রান্না করা আলুর তরকারি মেখে খেয়েছে।স্কুলে কোনদিন টিফিন দিতে পারিনি। লক্ষী মেয়ে আমার। কোনদিন বাড়ি এসে অনুযোগ করেনা। দোষ দেয়না আমাদের অপারগতাকে,দিয়ার মা বলে।

সামনে কি হল? গাড়ি আগায়না কেন? রায়হানকে লক্ষ্য করে সাব্বির বলল। রায়হান ভাই আজকে আমার চাকরির ইন্টারভিউ আছে। আজকে দেরি হলে আমার কপাল পুড়বে। চারিদিকে কিশের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাব্বির কাছে গিয়ে দেখে গাড়ির হর্নের শব্দ। শত শত স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী রাস্তায়। তোর ইন্টারভিউ আজ রাস্তায় হয়ে গেল ভাই, কুড়ি মিনিট হল বাস দাঁড়িয়ে, রায়হান ফোড়ন কাটে। সাব্বির একটু এগিয়ে গিয়ে দাড়িয়ে থাকা একটি মিনি বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে সামনে জ্যাম কেন?

কয়েকদিন আগে বাস চাপায় ছাত্র মারা যাওয়ায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে, তারা নিজেরা ড্রাইভারের লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট পরীক্ষা করছে, এইজন্য সামনে এত জ্যাম।

হয়ে গেল, আজকেই এসব হতে হবে, আমার দশটা থেকে ইন্টারভিউ। আর এখন আমি রাস্তায় এভাবে আটকা পড়লাম। আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে গেলেও বিশাল জ্যামে পড়বো। সাব্বির খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। এখন যা অবস্থা, এই জ্যাম উঠতে দু ঘন্টা তো লাগবেই যা মনে হয়। সাব্বির হতাশ হয়ে বলে। কি আর করা যাবে, ফোন করে অফিসে জানিয়ে দে লেট হবে। উপায় তো নেই। না রায়হান ভাই, অফিস তা মানবেনা। আমাকে যেতেই হবে যেভাবে হোক দশটা না হোক অন্তত এগারটার মধ্যে। না হলে চাকরির এই সুযোগ আবার কবে আসবে জানিনা। কিন্তু নিরুপায়। শুধুমাত্র বিমান বা হেলিকপ্টার ছাড়া এখান থেকে উদ্বার হওয়ার উপায় নাই।আর হেটে তুই খামার বাড়ি, এখান থেকে দশ কিলোমিটার রাস্তা, আধা ঘন্টায় কিভাবে যাবি? বাদ দে। চল ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেই। ওরা তো একটা মহৎ কাজই করছে। রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালনার বিপদজনকতা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে, সড়কে নিরাপত্তার গুরুত্ত্ব বিষয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছে। অনেক প্রশ্ন নিয়ে তারা মিছিলে শরিক হয়। এই মিছিল নিরাপদ সড়কের অধিকার আদায়ের।এই আওয়াজ নিরাপদে বাঁচতে চাওয়ার। ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে থাকে এ মিছিল।

মহাখালি রেল ক্রসিং এলাকা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সারাদিন খুব গুমোট গিয়েছে। এর মধ্যে ওরা গাড়ি নিয়ন্ত্রন করছে দক্ষ ট্রাফিক পুলিশের মত। বৃষ্টিতে ভেজা স্কুলের পোশাক, সারাদিন না খেতে পাওয়া শুকনা মুখে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট পরীক্ষা করছে। রাস্তার পাশের খুপরি দোকানের চট ঘেরা ছাউনি গুলোতে লোকজনের ভিড় বাড়ছে।কেউ কেউ সিগারেট ধরিয়েছে। কতগুলো স্কুলের বাচ্চা রাস্তা পেরুচ্ছে। সকল গাড়ি এমনকি পুলিশের গাড়ি পর্যন্ত বাধ্য শিশুর মত ওদের কথা শুনছে, চাওয়া মাত্র লাইসেন্স দেখাচ্ছে। এ কয়েক দিনে রাস্তার পরিবেশটাই ওরা পাল্টে দিয়েছে। ঢাকা নগরী যেন একটা ড্রিমল্যান্ডে পরিণত হয়েছে। যারা এই চেকিং করছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কিশোর বা স্কুল কলেজ ছাত্র। কিন্ত তারাই সবচেয়ে বেশি সংযত ও পরিশীলিত আচরণ করছে।

বাইরে প্রবল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। মাঝে মাঝে বাজের শব্দে পিলে চমকে যাচ্ছে, যেনো মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। একটা বিষাদ মাখা রাতের অন্ধকার গ্রাস করছে ঢাকা শহরকে, সারা শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্ত কয়েক দিন ধরে শওকত চৌধুরীর চোখে ঘুম আসছেনা। এবারের এই দুর্ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। সে এখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছেনা। ক্লাবে যাচ্ছেনা। নিজ ঘরে সোফায় শুয়ে বসে টিভি দেখছে আর এখানে ওখানে ফোন করে খবর নিচ্ছে। নানান কথা তার কানে আসে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছে দিয়াকে নাকি মাঝে মাঝে এখানে ওখানে দেখা যায়...গভীর রাতে এয়ারপোর্ট রোডে পথ চলতি মানুষদের থামিয়ে তাদের অনুরোধ করে নিয়ম মেনে রাস্তা চলাচলের। অনেকেই নাকি দেখেছে। শুনে শওকতের সারা শরীরে ভয়ের একটা স্রোত বয়ে গেল। শওকতের নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। তার মাথা ঘুরতে থাকল। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ভেসে উঠল দিয়ার মুখ। চমকে উঠলো সে। শওকত চৌধুরীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একি কান্ড! কি দেখছেন। একি ভুল নাকি মতিভ্রম হল। দুচোখ ভাল ভাবে কচলে আবার তাকাল। না মোটেও চোখের ভুল নয়। মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে দিয়া। রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। এক দিয়ার কাছ থেকে অবিকল দিয়ার মত দেখতে শত শত দিয়া বের হয়ে আসছে রাস্তায়। এক সপ্তাহ আগের শান্ত স্নিগ্ধ দিয়ার চোখে আজ অসুর দুলানির রুপ। সে দিকে তাকালে যেন চোখ ঝলসে যায়। দিয়া এসে দাঁড়ায় শওকতের সামনে। চোখে চোখ রেখে বলে কি ভেবেছিলেন আমি মরে গেছি। মরি নাই, বলতে পারেন পুনর্জন্ম হয়েছে আমার। কিছু ভাল ডাক্তারের কল্যাণে। এতদিন কিভাবে সড়ক হত্যা বন্ধ করা যায় তারই তালিম নিয়েছি, আমার বন্ধুদের শিখিয়েছি, ট্রেইনিং দিয়েছি। নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে আপনাদের মতো অর্থলোভী বাস মালিকদের শাস্তি দেবার জন্য নয়, রাস্তার শৃঙ্খলা শেখানোর জন্য, সড়ক হত্যা বন্ধের জন্য। এসব দেখে শওকত খুব জোরে চিৎকার করে মূর্ছা গেল।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ১০,২০১৮)