মারুফ কামরুল

মুখ ভরে বমি করছে চুটকি। আধ ভাঙা ভাত-ডালসহ হলদে রঙের পানি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। ভেঙচি কাটা মুখে করে নাকে রুমাল দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো তুহিন। দুহাতে কপালের রগ চেপে ধরে আছে চুটকি। তুহিন ফিরেও তাকায়নি। বরং একদলা থুথু ফেলে গেলো। টুকুন দাঁড়িয়ে দেখছে। তুহিনের থুথুর ছিটে কিছুটা টুকুনের মুখে পড়লো। তাতেও চোখ সরছে না চুটকির উপর থেকে। বমির আঁসটে আর গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে। অথচ টুকুন নাক পর্যন্ত চেপে ধরেনি। এমনভাবে দেখছে যেনো সে বমি করা দেখেনি। আজও একবার ভেবেছে চুটকির কপালটা চেপে ধরবে, যদি এতে ওর বমির কষ্ট কিছুটা লাগব হয়। গত কয়েকদিন থেকেই চুটকি কিছু খেতে পারছে না। প্রথম যেদিন বমি করলো সেদিন টুকুন দৌড়ে গিয়ে চুটকির কপালের রগ চেপে ধরে। তুষি নাথ এটা দেখে টুকুনের কান মলে বললো, সরে দাঁড়া হতচ্ছাড়া, মেয়ে মানুষ পেলেই কেবল ছুঁতে মন চায়! তাই না?

আজ তুষিনাথ উঠানে বসা আছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাছে যেতে পারেনি।
এরই মধ্যে নিতাই বাবু বাজার করে ঘরে ফিরেছে। হাতের ইশারায় টুকুনকে ডাকলো।
কিরে টুকুন, ঝিম মেরে বসে আছিস, মন খারাপ?
না, তেমন কিছু না!
চুটকি দেখি আজও বমি করছে! তোর কী মনে হয়?
ওর ভালো চিকিৎসা দরকার, যত্ন প্রয়োজন। আমার কাছে বিষয়টা ভালো ঠেঁকছে না!
আচ্ছা সেটা আমি দেখবো। তুই খেয়েছিস?
না, এখনো খাইনি।
কেনো রে! মন খারাপ করে থাকিস না। খেয়েনিস। আর আচ্ছা, আমার ইন্টার ফেল ছেলেটা কোথায় জানিস? বিয়া করার মুরোদও তো নাই!
তুহিন দা ঘরেই আছে।

তুষিনাথ শাড়ির আঁচল ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো, বলি কী সলাপরামর্শ হচ্ছে দুজনের। ঐ ছেরা! যা বমিগুলোতে ছাই দে! এখানে আসছে বুড়াদের সাথে গল্প করতে। কথাটা শুনে নিতাইবাবু স্ত্রীর দিকে তাকালো। তবে কিছুই বললো না।

টুকুন চুলা থেকে ছাই এনে বমিতে দিলো। চুটকি বমির পাশেই পড়ে আছে। টুকুন জল এনে হাত মুখ ধুইয়ে দিলো। নিজের গামছা দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিলো।

চুটকি যদি পড়ালেখা নিয়মিত করতো। তাহলে সে এবার ক্লাস এইটে পড়তো। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই চুটকির এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে দিন কাটে। মা একা কাজ করে সব খরচ জোগাতে পারে না। গত দুবছর ধরে নিতাই বাবুর বাড়িতে কাজ করে। তিন বেলা খাবার আর দু ঈদে কাপড় পায়। এই হলো তার পারিশ্রমিক। স্বামী স্ত্রী আর ছেলে তুহিন, এই হলো সংসার সংক্ষেপ। নিতাইবাবুকে মানুষের কাতারে ভাবা যায়। আর তুষিনাথ! ঘরে একটি বেড়াল আছে, সেও তুষিনাথের গলার আওয়াজ শুনলে পালিয়ে বেড়ায়। তুহিনকে ঠিক কী বলা যায়! থাকুক এটা। আর নির্বিকার ছেলেটি, টুকুন। সে নিতাই বাবুর ভাতিজা। টুকুনের বাবা ছিলো পাগল কিছিমের মানুষ। বাবার পাগলামি মা সইতে পারেনি। ছোট্ট টুকুনকে ফেলে তার মা চলে যায়। একটু বড় হওয়ার পর একদিন বাবাও নিখোঁজ হয়। দুদিন পর পুকুরে কচুরির নিচ থেকে লাশ ভেসে উঠে। এরপর থেকে টুকুন চাচার কাছেই থাকে।

টুকুন ধীরে ধীরে চুটকির কাছে গেলো। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কীরে! এখন কেমন লাগছে?
টুকুন দা, তুমি আমারে মাফ কইরা দিও। তোমারে খুব জ্বালাইছি!
আরে পাগলি, এসব বলতে নেই- তুই সুস্থ হয়ে উঠবি।
আমার খারাপ লাগতেছে দাদা, বাঁচুম না আমি। আমার মায়রে দেখতে মন চায়।
চিন্তা করিস না, আজ বিকালে চাচা তোকে ডাক্তার দেখাবে।
আল্লাহরে! আল্লাহ- ওয়াক...ওয়াক...ওয়য়াক..
আবার বমি করছে চুটকি। মুখ ধরে চুটকি বাইরে যেতে চেষ্টা করেও পারেনি। ঘরের দরজায় বসে পড়ে। তুষিনাথ স্নান সেরে এসেছে। ঘরের দরজায় বমি দেখে ক্ষেপে গেলো- এই নিচু জাতটার হলো কী! এই তুহিনের বাপ, শুনেন, এই ম্লেচ্ছটাকে বাড়ি পাঠান। ঘর দরজা সব নোংরা করছে। অসহ্য হয়ে গেলাম। মুসলমানের বাচ্চাটার বমি বন্ধ হয় না কেন?

চুটকি এখনো কপালের রগ চেপে ধরে ওয়াক ওয়াক করছে। নিতাইবাবু এমন ভান করলো, মনেহয় তিনি কিছুই শুনেনি। এ ছাড়া বেচারারই বা কী করার আছে? তুষিনাথের বকা শুনতে শুনতে তো জীবন পার করলো। তুষি নাথ চোখ রাঙিয়ে টুকুনকে বললো, ঐ, দাঁড়িয়ে দেখছিস কী! ছাই এনে দে বমির উপর! চুলায় তো মনে হয় ছাইও শেষ, যেমনে পারিস পাঁচ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার করবি।
টুকুন, চুটকির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চুটকি কাঁদছে। বমি করতে করতে চোখ মুখ ফুলে গেছে। টুকুন শুধু ‘কাঁদিস না’ বলে চুলার পাড়ে গেলো। ছাই পায়নি। পানি এনে বমি পরিস্কার করছে। চুটকি বললো, টুকুন দা, তুমি আমার লাইগা এতো কষ্ট করো ক্যান!
জানি না রে চুটকি। কিন্তু তোর জন্য কষ্ট হয়।
দাদা, তুমি আমারে একবার মায়ের কাছে নিয়া চলো, মায়রে খুব দেখবার মন চায়। কতদিন দেখি না। মরে গেলে তো আর দেখুম না।
তুই সুস্থ হ। আমি সব ব্যবস্থা করবো। মন খারাপ করিস না চুটকি। আমার মায়ের চেহারাই আমার মনে নেই। আমার চে তোর বেশি কষ্ট নাকি! হু?
দাদা মন খারাপ কইরো না, আমার মা, তোমারও মা। চলো না আমারে নিয়া। কত সুন্দর বাতাস আমাগো বাড়িতে। মা আছে, ছোট্ট একটা বেড়াল আছে। দেইখো তোমারে মায় খুব আদর করবো! যাবা না দাদা?
ওরে পাগলি বোন। ওঠ তো এখন! চাচা তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ঘাটে চল, হাতমুখ ধুয়ে নে।

টুকুন, চুটকিকে নিয়ে ঘাটে গেলো। বেশ কয়েকদিন অসুস্থতার জন্য ঘাটে যায়নি চুটকি। ধোয়াপাকলা টুকুনই সেরেছে। পুকুর পাড়ের এক জঙলা গাছের সাথে প্রতিদিন চুটকি তার গল্প করতো। সেই দুইপাতা থেকে গাছটার সাথে বন্ধুত্ব। আজ আবার দুজনের দেখা হলো। চুটকি গাছের মোলায়েম পাতায় হাত বুলাচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। চুটকি গলা কেঁপে কেঁপে বলে উঠলো, তুইও রাগ করছচ আমার লগে? কতদিন দেখি না তোরে। তোর কত সুন্দর ফুল ফুটছে রে। দেখছচ তুই? থাক কথা কইতে হইবো না। তোর তো এখন ফুল আছে, ওর লগেই কথা ক। ছোট্ট গাছটি এক ডাল অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিষন্ন বাতাসের সাথে দুলছে। ফুলগুলো কোমল সৌন্দর্য নিয়ে ঝুলে আছে। মাথা ঝুঁকে বসে আছে চুটকি। পুকুরের পানিতে এক সহজ প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। কতদিন নিজের চেহারা দেখা হয় না। বদলে যাওয়া নিজেকে দেখছে চুটকি। তেলমুক্ত উসকো চুল, চোখমুখ ফোলা। পানির নিচের চুটকির দিকে তাকিয়ে ঝুঁকে থাকা চুটকি প্রশ্ন করে, তুই কি সত্যি আমি! এমন হইয়্যা গেলি কেমনে? তোরে যে আমি চিনতে পারি না। তোর গা এতো ডাগর হইলো ক্যান? এতো চোখের নজর থেইকা নিজেরে বাঁচাইবি কেমনে?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টুকুন বললো, কীরে, কী এমন দেখছিস! জলদি আয় না। তোর জন্য চাচা বসে আছে।
পানি সেদিন টলেনি। কোনো জবাব আসছিলো কিনা জানি না। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে চুটকি মৃদু স্বরে বললো, দাদা তুমি যাও, আমি আইতাছি।
চুটকির মনে পড়ে সেই ঝড়ের রাতের কথা। মাস পাঁচেক আগে নিতাই বাবু আর তুষি নাথ বেড়াতে গেলো। বাড়িতে তুহিন আর চুটকি। তুহিনকে রান্না করে খাওয়ানো আর সংসার দেখে রাখার দায়িত্ব চুটকির। সেদিন বিকাল থেকে ঝড় হাওয়া বইছিলো। বেশ কিছু আম ঝরেছে। চুটকি ভিজে ভিজে কয়েকটি আম কুড়িয়ে আনে। সন্ধ্যা গড়াতেই হালকা জ্বর অনুভব করছে। তুহিনকে রাতের খাবার দেয়। চুটকি খায়নি, মন টানছে না। তুষিনাথ বারবার বলে গেছে, তুহিনকে যেনো শোবার আগে দুধ দিতে না ভুলে। তুহিন বসে ফোন টিপছে।

চুটকি বললো, আসুম তুহিন দা?
আরে আস। আবার অনুমতি লাগে নাকি?
এই নেন আপনার লাইগা দুধ। খাইয়া নেন। আমি যাই...
বোস না একটু, যাচ্ছিস কোথায়? প্রতিদিন এক দুধ ভালো লাগে বল?
না, আমার খারাপ লাগতেছে, ঘুমামু।
তুহিন, চুটকির হাত ধরে টান দিয়া বিছনায় বসিয়ে বললো, বোস এখানে। তোরে তো অনেক সুন্দর লাগছে। খেয়াল করিনি তো- আমায় একটু আদর কর না, চুটকি! চুটকি উঠে যেতে চাইলেও তুহিন তাকে আবার জোর করে টেনে কাছে আনে। চুটকি ছোটাছুটি করছে- কী কন দাদা এগুলা? দাদা আমারে যাইতে দেন। আমার শরীল খারাপ। আমি আপনার বইন না? তুহিন উচ্চ হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, দাদারে আদর করে দে, তাহলে ছেড়ে দিবো। ঝড়ের সারারাত মানুষে পশুতে যুদ্ধ হলো, মানুষ হেরে গেলো। থেকে থেকে চুটকির আওয়াজ পাওয়া গেছে- দাদা, আমি মইরা যামু! এবার আমারে ছাইড়া দেন। আপনার পায়ে ধরি আমার এমন সর্বনাশ কইরেন না। আমি আপনার বইনের মতো। কোনো আকুতির দাম দেয়নি তুহিন। পশুর মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ হয়েছিলো। শেষ রাতে তুহিন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, যা মাগি, যেখানে মন চায় যা।

সকালের আলো ফোটার আগেই চুটকি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির পথে চলল। পথে দেখা টুকুনের সাথে। টুকুন ছিলো খালার বাড়ি, সেখান থেকেই ফিরছিলো। চুটকি চাইছিলো টুকুন ফিরার আগেই চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে।
টুকুন আশ্চর্য হয়ে বললো, কিরে তুই এতো সকাল কোথায় রওনা দিলি? আর এই, তোর এই দশা কেনো?
টুকুন দা আমার সব শেষ। আমি বাড়িতে যামু। আমারে লইয়া চলেন.... হু হু হু...
আরে কাঁদিস না, আমাকে খুলে বল, কী হয়েছে? কাছে আয় দেখি। তোর গায়ে দেখি খুব জ্বর। চল এখন, ঘরে চল। জ¦র একটু কমুক, আমি তোকে দিয়ে আসবো।

আর যাওয়া হলো না...

আজ পুকুর পাড়ে এসে নিজের চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখে সব মনে পড়ছে। পুকুর পাড়ের চারা গাছটার মতো এক ভীষণ রকম পরিবর্তন এসেছে। এখন আর চারা নেই, ফুল এসেছে, ফল ধরবে। চুটকি ভাবে চারা গাছটি কী তার মতো ঝড়ের রাতে ঝড়ের কবলে পড়ছিলো?

ডাক্তার সাহেব বললেন- তেমন কিছু নয়, চিন্তা করবেন না নিতাইবাবু। এই সময়ে একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। আর আমি ঔষুধ লেখে দিচ্ছি। চুটকির দিকে তাকিয় বললেন- একটু হাসো মা, তোমার জন্য শুভ কামনা। নিজের খেয়াল রেখো কিন্তু...
আচ্ছা ডাক্তার বাবু, আজ তাহলে উঠি!
আর হ্যাঁ! কাল রিপোর্ট টা একবার দেখাবেন, ঠিক আছে, ভালো থাকবেন।

রাতের খাবার শেষে তুষিনাথ বললো- এই টুকুন! ম্লেচ্ছটাকে কালেকেই বাড়ি দিয়ে আসবি, মনে থাকে যেনো।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
এখন দাঁড়িয়ে দেখছিসটা কী! প্লেটগুলো ধুয়ে আন। অলক্ষী দিয়ে ঘর ভরেছে, যত্তসব!

টুকুনের চোখের কোণে দুফোঁটা স্বচ্ছ জল টলটল করছে। প্রতিফলিত হচ্ছে চিকচিকে বেদনাময় গল্প। প্লেটগুলো ধুতে নিয়ে গেলো। একেরপর এক প্লেট ধুয়ে চলছে। পিঠের উপর হাত রাখার আবেশ পেয়ে পেছনে তাকলো। চুটকি দাঁড়িয়ে আছে, এখনো হাত টুকুনের পিঠে, চোখ টুকুনের মুখের উপর। চোখে জলের পরিমাপ বেড়ে চলছে। গাল বেয়ে পরপর কয়েক ফোটা জল মাটিতে পড়লো।
টুকুন দা, বাকি পেলেট গুলা আমি ধুমু। কতদিন পেলেট বাটি ধরি না। দেও না একটু করি।
নাহ, তোর শরীর খারাপ করবে।
দাদা, কিছু খারাপও ভালা হয়। দেও না, এরপর আর কখনো তোমারে বিরক্ত করুম না, তুমিই ধুইয়ো, শুধু আইজকা দেও।
আচ্ছা নে। কিসব আবোলতাবোল বলছিস কিছু বুঝি না।
দাদা, তোমারে একটা কতা জিগাই? ধরো আমি বহু দূরে গেলেগা তোমার খারাপ লাগবো?
চুটকি, তোকে কোথায় যেতে দিবো না বোন। এমন কথা কেনো বলছিস?
আমারে মাফ কইরা দিও দাদা। যাইতে হইবো বহু- বহু দূর...
আমার কিচ্ছু বুঝে আসছে না
ঐযে মানুষ কয় না জীবনের লক্ষ্য, সেটাই কইলাম

টুকুন রুমে চলে গেলো। চুটকি আয়নার সামনে দাঁড়ালো, কপালে নীল টিপ দিলো । চুলের বেণী খুলে দিয়েছে। সবচে সুন্দর জামাটা, খুঁজে বের করলো। ঠোঁটে গাঢ় লিপিস্টিক দিলো। আয়না তাকিয়ে বার তিনেক হাসি দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে আনন্দ সাধনার জন্য। রাত বাড়ছে, অন্ধকার চারপাশে ঝাপটে ধরছে। এক কোকিল অন্য কোকিলকে দেখতে পাচ্ছে না, যেনো মৃত্যুকে দেখলেও মানুষ কিংবা মানুষকে মৃত্যু মনে হয়। সবাই ঘুমিয়েছে। বিড়ালটি তখনও ঘুমোয়নি। চুটকি ধীর লয়ে বিড়ালটির কাছে গেলো। মুখোমুখি বসলো। বিড়ালটি অপলক তাকিয়ে আছে। ‘কিরে ধলো! আজ খাইছচ নি? তোর পশমগুলা এমন মলিন হইয়া গেছে ক্যান!’ ধলোর শরীরে হাত বুলিয়ে চুটকি বললো, আয় ধলো, একটু কোলে আয়। তোরে কতদিন কোলে লই না। ধলো চুপটি করে কোলো চলে এলো। চুটকি ধলোকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ধলো কান খাড়া করে চুটকির বুকের ধড়ফড়ানি শুনছে। ধলো ‘মেউ’ শব্দে ডেকে উঠলো। চুটকির মুখের দিকে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। থেকে থেকে করুণ স্বরে ডেকে উঠছে। ধলো জানতে চাচ্ছে চুটকির কী হলো!
ধলো, তুই কান্দোছ ক্যান! আমার কিচ্ছু হয় নাই। এই দ্যাখ কত সুন্দর কইরা সাজছি। এখন ক তো, আমারে কেমন লাগছে?

ধলোর চিকন গোঁফ দুপাশে সরে গেলো। সাদা দাঁত দেখিয়ে যেনো মিটিমিটি হাসছে। ধলো কখনো চুটকিকে এমন সাজতে দেখেনি। চুটকির গাল বেয়ে এক ফোট জল ধলোর নাকে পড়লো। চোখ সরছে না, ধলো তাকিয়ে আছে। সামনের পা দুটো দিয়ে চুটকির গাল মুছে আদর করছে। চুটকি ধলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কতা তোর মনে হইবো? আচ্ছা, তুই আমার কত্ত আগে এই বাড়িতে আইছচ, এতো ধৈর্য কই পাছ! আমি আর পারি না রে। আমারে একটু শিখাবি? ধলো মৃদু স্বরে মিয়াউ মিয়াউ করছে। তার সব ভাষা চুটকি বুঝে। চুটকি, ধলোকে কোল থেকে নামিয়ে বললো- যা ধলো এবার ঘুমা, আমারেও ঘুমে ডাকতাছে। ধলো কান নেড়ে কী যেনো বলছে। চুটকি, টুকুনের রুমের দিকে হাঁটছে। সামনে গিয়ে ভাবলো রাত করে ওনার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে না। ফিসফিসিয়ে অথচ গম্ভীর গলায় বললো- টুকুন দা, ঘুমাইয়া গেছো! ও টুকুন দা...
টুকুন ঘুমের ঘোরে বললো, বোন এখন যা, ঘুম পাচ্ছে খুব। সকালে শুনবো, বোন আমার।
চুটকি মুখভার করে বললো- সব রাইতের সকাল হয় না, টুকুন দা; সব রাইতের সকাল হয় না।

দরজা খোলার শব্দ হলো। চুটকি খোলা চুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঘুটঘুটে আঁধার, অশান্ত মোহ তার, হেঁটে চলছে একা। নিজের ভেতরে অন্য একটা সত্তা খেলছে, হাত পা নেড়ে মুক্তির আয়োজনে ব্যস্ত। চুটকিও মুক্তির টানে অন্ধকার মোহে পড়েছে। পেটের উপর হাত বুলিয়ে দেখছে, ভেতর থেকেও কেউ একজন হাত বুলাচ্ছে। পেটের তকতকে চামড়া, দুটি হাতের মাঝে বাধা হয়ে আছে। চুটকির স্বগতোক্তি- মা, তোমারে খুব মনে পড়তাছে, আমিও তোমার ভিতরে থাইকা এমন খেলা করছিলাম, তাই না? এতো কষ্টের মাঝেও জীবনরে আরো কয়েকটা সকাল বাঁচাইয়া রাখতে মন চায়। তুমি এহনো যেমন বাঁচাইয়া রাখছো। আজ জীবন বাঁচাইয়া রাখার তাড়না শেষ হইয়া গেছে। খুব আন্ধাইর পড়ছে। লুকাইয়া যাওনের সময় হইয়া গেছে। তোমারে দেহার কপাল হয় না বইলা দুঃখ নাই! তুমিও এই সমাজেরই একজন। ভালো থাইকো, মুক্তির পথে হাঁটতাছি...

চুটকি পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলো। গভীর অন্ধকারেও জলের একটি রঙ দেখা যায়। পুকুরের দিকে চেয়ে আছে। কোন গভীরতায় সে দুঃখ জমা রাখে, মাছের দুঃখ, পোকামাকড় আর জলজ উদ্ভিদের সমস্ত বেদনা! মাছেদের সাথে চুটকির কী জায়গা হবে? হাতড়ে ছোট্ট জঙলা গাছটা খুঁজে বের করলো। হাত বোলালো ঝুলতে থাকা ফুলগুলোতে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। গোপন পানীয় গলায় ঢেলে দিলো। চোখ বুজে এলো ঘুমের ডাকে। পুকুরে অসম্ভব সুন্দর নীরবতা। চুটকি বারবার পেটের উপর হাত বোলায়, ভেতরে কেউ কাঁদছে। চুটকি বললো- আমরা একলগে মুক্তি নিমু, কান্দিস না। একটু ধৈর্য ধর।

কিছু একটা পানিতে পড়ার শব্দ হলো। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ধলো ‘মিয়াউ মিয়াউ’ করছে। হঠাৎ শান্ত পুকুরে জলকম্পন শুরু হলো। জলকম্পন থেমে গেলো আলো ফোটার আগেই। একটি উড়না পুকুরে ভাসছে। জঙলা গাছটি বিষন্ন বাতাসে দুলছে, তার ফুলগুলো কাদায় গড়াগড়ি করছে।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২১,২০১৮)