দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : স্বাস্থ্য খাতে ৮৫ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে তোলপাড় চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে সরকারি পাঁচ হাসপাতালের নামে এই টাকা লোপাটের সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের হস্তক্ষেপে শেষ মুহূর্তে সিন্ডিকেটটির এই অপতৎপরতা ভেস্তে যায়। জড়িত থাকার অভিযোগে এক উপসচিবকে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বরাদ্দের ৮৫ কোটি টাকা লোপাটের জন্য পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে এক খাতের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করার অনুমোদনও বাগিয়ে নেয় এ সিন্ডিকেট। যদিও যেসব হাসপাতালে অর্থ বরাদ্দের জন্য ফাইল পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ সম্পর্কে কিছুই জানত না।

চলতি অর্থবছরের ৩০ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে পাঁচটি সরকারি হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পুনঃউপযোজনের প্রস্তাব করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। উপসচিব রেহানা ইয়াসমিন ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চলতি বছরের ১৪ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। সংশ্নিষ্ট পাঁচটি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে- রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পাঁচশ' শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, আড়াইশ' শয্যার গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এবং আড়াইশ' শয্যার মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল।

এর মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহ খাতে ৩২৫২১০৫ কোডে ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেখান থেকে সচিবালয় ৪১১২৩১৫ নম্বর কোডে ২০ কোটি টাকা পুনঃউপযোজন করে একই প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে সচিবালয় ৪১১২৩১৫ নম্বর কোডে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি খাতে ৩৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এই বরাদ্দ থেকে এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৫ কোটি টাকা, মুগদা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ২০ কোটি টাকা এবং ২৫০ শয্যার গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ২০ কোটি টাকা পুনঃউপযোজন করা হয়েছে। এ ছাড়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ৩২৫২১০৫ নম্বর কোডে চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহ খাতে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এই বরাদ্দ থেকে টাকা কেটে সচিবালয় ৪১১২৩১৫ নম্বর কোডে ১০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এ টাকা ২৫০ শয্যার মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে পুনঃউপযোজন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে অন্ধকারে রেখে মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র এ ঘটনা ঘটায়। বিষয়টি জানার পর তিনি এই বরাদ্দ প্রত্যাহারের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেন। মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি চিঠি দিয়ে ওই অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবদুস সামাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, প্রশাসনিক প্রয়োজনে অর্থ বিভাগের আগের সম্মতি নির্দেশক্রমে প্রত্যাহার করা হলো। উল্লেখিত পুনঃউপযোজনকৃত টাকা থেকে কোনো বিল দাবি করা যাবে না এবং এ বাবদ কোনো বিল পরিশোধ করা যাবে না। এ আদেশের অনুলিপি স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে।

ঘটনার নেপথ্যে যারা : নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের আমলাদের একটি সিন্ডিকেট ৮৫ কোটি টাকা লোপাট করতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ঠিকাদার মিঠু যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ করা অর্থের মধ্যে ৮৫ কোটি টাকা পুনঃউপযোজন করে অন্য খাতে নেওয়া হয়েছিল। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতেও এই ঠিকাদারের নাম এসেছে। ডা. আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার সময় উত্থান ঘটে আলোচিত এ ঠিকাদারের। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে একসঙ্গে তিন থেকে চার বছরের টেন্ডার করে যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নেন তিনি। এ সময় কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছিল। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে নির্ধারিত যন্ত্রপাতির বদলে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছিল।

মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ঠিকাদার স্বাস্থ্য খাতের কাজকর্মে পিছিয়ে পড়েন। যদিও গত সরকারের আমলে টেন্ডার করে রাখায় এই মেয়াদের প্রথম দুই বছর বরাদ্দ পেতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু দুই বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে ঠিকাদার মিঠুকে ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পাঁচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য : মৌলভীবাজারের ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পার্থ সারথী চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরে তিনি যন্ত্রপাতি কেনার কোনো চাহিদা পাঠাননি। এ নিয়ে কোনো টেন্ডার প্রক্রিয়াও হাসপাতালে হয়নি। কে বা কারা এ ধরনের বরাদ্দ দিয়েছেন সে সম্পর্কেও তিনি জানেন না। যদিও ১০ কোটি টাকার বরাদ্দ বাতিলের চিঠি পেয়েছেন।'

প্রায় একই কথা বলেন রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. অজয় কুমার রায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, 'যন্ত্রপাতির চাহিদা ছিল; কিন্তু টাকার বরাদ্দ পাইনি। তবে সেটা বছরের প্রথম দিকে। এই অর্থবছরে কোনো চাহিদা দেইনি।'

দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. আমির আলী জানান, বরাদ্দ দেওয়া আবার তা বাতিলও হওয়া- এ দুটির কোনোটি সম্পর্কেই জানেন না তারা। গত অর্থবছরের মে-জুন মাসে তারা একটি চাহিদা দিয়েছিলেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বিশেষ করে আগস্টে কোনো চাহিদা দেননি। তিনি বলেন, এক অর্থবছরের টাকা আরেক অর্থবছরে দেওয়া সম্ভব নয়। আইন অনুযায়ী এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য মন্ত্রণালয় যদি অনুমোদন দেয়, তাহলে সম্ভব।

গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উল্লেখিত ২০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়ে তিনি কোনো চিঠি দেননি।

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আমিন আহমেদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে কয়েকদিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি এখনও কিছু জানেন না।

সচিব ও উপসচিবের বক্তব্য : স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান প্রথমে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। পাঁচটি সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ বিভিন্ন খাতে পুনঃউপযোজনে সম্মতি প্রত্যাহারের বিষয় তুলে ধরা হয়। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সচিব বলেন, বিষয়টি তার মনে নেই। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে কর্মকর্তা পুনঃউপযোজনের জন্য স্বাক্ষর করেছেন, বিষয়টি তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

ওই উপসচিব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নেই- এমন তথ্য তুলে ধরে বক্তব্য চাওয়া হলে সিরাজুল হক খান বলেন, তাহলে খোঁজ নিয়ে দেখেন, তিনি কোথায় আছেন। অথবা ওই শাখায় যিনি আছেন তার কাছে জানতে চান। বিষয়টি তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাশ কাটিয়ে অধীনস্ত উপসচিবের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেন, পাশ কাটানোর কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন যে, বিষয়টি তার মনে নেই। বিষয়টি উনি (উপসচিব) খোলাসা করতে পারবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপসচিব রেহানা ইয়াসমিন বলেন, তিনি এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার দায়িত্বে নেই। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে চান না।

সচিবের বক্তব্য জানিয়ে মতামত দিতে বললে রেহানা ইয়াসমিন বলেন, ডেস্ক অফিসার একা কোনো কিছুই করতে পারে না।

সে ক্ষেত্রে কার আদেশে আপনি ওই ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন?- এ প্রশ্নের জবাবে উপসচিব রেহানা ইয়াসমিন কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/অক্টোবর ২৩,২০১৮)