পাভেল চৌধুরী

গেল মাসের ৪ নভেম্বর জনাব তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর ৫ নভেম্বর স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে তাঁর জানাজায় যত মানুষের সমাগম হয়েছিলো ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত জানাজা তো দূরের কথা স্মরণকালের কোনো ধরণের জনসভাতেও, সে প্রধানমন্ত্রীর হোক বা বিরোধীদলের প্রধানের, এতো জনসমাগম হতে দেখা যায় নি। রাজনৈতিক দলের জনসভায় লোক হাজির করার নানা ধরণের কৌশল থাকে, তাগিদও থাকে, অনেক সময় জনসভায় উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়; পরিবহন সুবিধা দেওয়া, খাদ্য সরবরাহ করা, ক্ষেত্র বিশেষে নগদ টাকাও প্রদান করা হয় বলে শোনা যায়। জানাজায় সেসবের বালাই নেই, বাহ্যিক কোনো তাগিদও নেই। এখানে মানুষ উপস্থিত হয় একান্তই তাঁর অন্তর্গত তাগিদে, হার্দিক উপলদ্ধি বশত জীবিত থাকাকালীন তরিকুল ইসলামের নিন্দুকের অভাব ছিলো না। সমালোচকও ছিলো প্রচুর, তারপরও জানাজায় মানুষের উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে, এমনকি খোদ তাঁর সমর্থকদেরও।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এরকম হওয়ার কারণ কী? অবশ্যই রাজনীতি। তরিকুল ইসলাম রাজনীতি করতেন আপদমস্তক ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তি। রাজনীতির প্রধান বিষয়টিই হলো মানুষ, মানুষের মনে ঠাঁই নেওয়া। মানুষের সাথে সংযোগ বাড়ানো। সর্বোপরি মানুষের যৌক্তিক আস্থা অর্জন করা। এই কাজটা যিনি যত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবেন তিনি ততো বড়ো রাজনীতিক। প্রশ্ন হলো এই কাজটা কি কোনো কৌশলগত ব্যাপার? মোটেই না। এর মূল বিষয়টাই হলো মানুষের প্রতি অঙ্গীকার যে অঙ্গীকার তাঁকে মানুষের আস্থাভাজন করে তোলে। এই আস্থা অনেক সময়ই দলের রাজনৈতিক গোন্ডিকে পেরিয়ে যায় আর তখনই ব্যক্তি হয়ে ওঠে দলের রাজনীতির থেকে বড়ো, দলের জন্য অপরিহার্র্য। যে কারণে একজন মানুষ কতবার ভোটে জয়লাভ করলো কিংবা কতবার মন্ত্রিত্বের আসন অলংকৃত করলেন ইত্যাদি এসব বিষয় দিয়ে মানুষকে পরিমাপ করা যায় না। মানুষের পরিমাপের বিষয় একটাই আর সেটা হলো কতজন মানুষের তিনি যৌক্তিক আস্থা অর্জন করতে পারলেন সেটা।

তরিকুল ইসলাম সেটা পেরেছিলেন। সাধারণ ভাবে আচরণে তিনি ছিলেন রুক্ষ, রূঢ়ভাষী, উচিৎ কথা বলায় ছিলেন দ্বিধাহীন কিন্তু তাঁর এই আচরণ মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়নি বরং কাছে টেনেছে। আটপৌরে জীবন যাপন ছিলো তাঁর, ক্ষমতায় থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি, তিনি যেমন তেমনই ছিলেন। অনমনীয় জেদ ছিলো। রাজনীতি করতে এসে তিনি যতোটা জুলুমের শিকার হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে তার দৃষ্টান্ত সমসাময়িক সময়ে পাওয়া যাবে না। অসীম সাহসের অধিকারী ছিলেন। সেই ছাত্র রাজনীতির সময় থেকেই তাঁর সাহসের নানা দৃষ্টান্ত এখনও তৎকালীন সহপাঠীদের মুখে শোনা যায়।


‘দশ ঘোড়ার গাড়ি হাকিয়ে’ নিরাপত্তা প্রহ আর স্তাবক পরিবেষ্টিত হয়ে আমাদের নেতারা ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শন করতেন না। নেতারা ছিলেন জনগণের পাশে, সন্নিকটে। অতীতের রাজনীতিকদের দিকে যদি তাকানো যায়,- শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, আবুল মুনসুর আহমেদ, মনি সিংহ, অলি আহাদ এ রকম অনেকে, সর্বোপরি মওলানা ভাসানি, এঁদের মধ্যে এই চিত্রটা আমরা দেখতে পাবো।


আসলে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একটা রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার ফল। ছাত্র রাজনীতি করেছেন স্থানীয় সরকারের রজনীতি করেছেন, তারপর জাতীয় রাজনীতিতে অবস্থান নিয়েছেন। সে আমলে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছাত্র রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিলো কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতো। প্রকৃতপক্ষে এসব ছিল নেতৃত্ব গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যারা এইসব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বন্ধুর পথ সফল ভাবে অতিক্রম করতে পারতেন তারাই পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন। এখন এইসব প্রক্রিয়া আর নেই। সুস্থ্য ছাত্ররাজনীতির বিষয়টাও বিলুপ্ত প্রায়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও স্থানীয় জনগণের ভূমিকা কম। নেতা নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন হয় না। নেতা এখন অবতীর্ণ হয় উপর মহল থেকে, ফরমান জারীর মাধ্যমে। জনগণের কাছে নেতাদের জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয় না বরং নেতারা যা নির্দেশ করেন সেই নির্দেশ পালনে মাঠ গরম করে ফেলে স্তাবকের দল। তাতে লাভ উভয়েরই হয়, নেতাদের যেমন, তেমন স্তাবকদের। জনগণের কি হলো সে হিসেব কেউ রাখে না।

যাহোক, এটাই যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল তা কিন্তু না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল সততার, জবাবদিহিতার আর অকৃত্রিমতার। ‘দশ ঘোড়ার গাড়ি হাকিয়ে’ নিরাপত্তা প্রহরী আর স্তাবক পরিবেষ্টিত হয়ে আমাদের নেতারা ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শন করতেন না। নেতারা ছিলেন জনগণের পাশে, সন্নিকটে। অতীতের রাজনীতিকদের দিকে যদি তাকানো যায়,- শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, আবুল মুনসুর আহমেদ, মনি সিংহ, অলি আহাদ এ রকম অনেকে, সর্বোপরি মওলানা ভাসানি, এঁদের মধ্যে এই চিত্রটা আমরা দেখতে পাবো। তরিকুল ইসলাম ছিলেন এই ধরারই উত্তরসূরি। আচার-আচরণ, চাল-চলন, জীবন যাপনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অকৃত্রিম। যে কারণে জনগণের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিলো দৃঢ়। জনগণের আস্থা ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন, সমালোচনার ঝড়ও তাঁকে তেমনই সহ্য করতে হয়েছে।

গত শতকের ৮০ আর ৯০ দশকে অগ্রজের বন্ধুত্বের সুবাদে তরিকুল ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছিল। আমি তাঁর রাজনীতির অনুসারী ছিলাম না, ভক্তও না। তিনি ছিলেন আমার শ্রদ্ধার পাত্র, আমি স্নেহের। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু ঢাকাতে তাঁর কোনো স্থায়ী আবাস ছিল না। আমার ভাইয়ের বাড়িতেই থাকতেন। তখন রাতের পর রাত তাঁর সাথে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন নিশিজাগানিয়া। রাত যত বাড়তো তাঁর আবেগ ততো বাড়তো। অসাধারণ কথক, বিরতিহীন ভাবে তিনি কথা বলে যেতেন। কত রকমের প্রসঙ্গ, দেশ বিদেশ অতীত ভবিষ্যৎ কোনোকিছুই বাদ পড়তো না। যশোরের কত মানুষের খবর যে তিনি পুংখানুপুংখ রাখতেন জেনে বিষ্মিত হতে হতো। আমি তখন তাঁর রাতের একমাত্র সঙ্গী। বইয়ের ভক্ত ছিলেন। মুঠো ভর্তি করে টাকা দিতেন বই কেনার জন্য। নিজের কাছে টাকা না থাকলে ধার করে দিতেন। আর পছন্দ অনুযায়ী তাঁকে বই কিনে দিতে পেরে আমি নিজেও যথেষ্ট আনন্দ পেতাম। একবার, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তরিকুল ভাই অনেকটা আত্ম গোপনে। আমি আমার এক বন্ধু মিলে ঢাকা থেকে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সরকার তখন এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে নতুন করে সব রকম পত্রিকা ডিক্লারেশন দেওয়া বন্ধ করেছে, কেবল মাত্র প্রেসিডেন্টের হাতেই তখন সে এক্তিয়ার। আমরা যেয়ে ধরলাম তরিকুল ভাইকে। তিনি একটা চিঠি লিখে দিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে। জীবনের প্রথম সচিবালয়ে ঢুকে প্রাপকের কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া হলো। অপেক্ষা করার বার্তা এলো আর সেই যে অপেক্ষা, একেবারে বিকেল পর্যন্ত। আমাদের তো নাভিশ্বাস অবস্থা। শেষে ডাক পড়লো। তখন সচিবালয়ের সব অফিস বন্ধ হতে চলেছে। ভেতরে ঢুকে দেখি একবারে ভিন্ন পরিবেশ; সচিব মহোদয় এতো আন্তরিক! প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করলেন এতোক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য তারপর খাদ্য খাবার আনলেন প্রচুর। খোশগল্প শুরু করলেন। পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ থেকে আমরা যাতে সরে আসি সে ব্যাপারে নানা ভাবে বুঝাতে লাগলেন কিন্তু যখন বুঝলেন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল তখন বললেন,- ঠিক্ আছে, যার সুপারিশ তোমরা এনেছো তাঁকে তো আমি ফিরাতে পারবো না, ব্যবস্থা করে দেবো। তিনি সে ব্যবস্থা করেছিলেন, পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়া গিয়েছিল, যদিও আমার বন্ধু সেটা নিয়মিত প্রকাশ করতে সামর্থ হয় নি।


তিনি আত্মগোপনে। ঢাকায় এক বাড়ীতে যেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর দেখা পেলাম। মানসিক ভাবে তিনি তখন কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, শারীরিকভাবেও খুব সুস্থ্ না। নানা ধরণের কথাবার্তার পর বললাম,- ক্ষমতায় থেকে এতো যে কোটি কোটি টাকা আয় করলেন সেসব কি হলো?
তিনি একটু চুপ করে থাকলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,- কি যে হলো, এখন সরকারও খুঁজে পাচ্ছে না, আমিও খুঁজে পাচ্ছিনে।


তরিকুল ভাই বিশেষ ভাবে যশোরকে ভালোবাসতেন। ঢাকা তাঁর কাছে ছিলো অসহ্য জায়গা। যদিও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জীবনের শেষ ক’বছর তাঁকে ঢাকাতেই অধিকাংশ সময় থাকতে হলো। কিন্তু তাই বলে তাঁকে যশোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন হবে না। একজন জাতীয় নেতার পরিধি হচ্ছে গোটা দেশ, সমগ্র জাতি। বিএনপি’র রাজনীতিতে তিনি ছিলেন অন্যতম নীতি নির্ধারক। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। একাধিকবার দলের সংকটজনক সময়ে তিনি শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন। বর্তমান সময়েও সুস্থ্য আর জীবিত থাকলে তাঁকে দলের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা পালন করতে হত। এরকম একজন দুঁদে রাজনীতিককে যদি দেশের সীমিত এলাকার ইট সিমেন্টের উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় তবে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার প্রতি সুবিচার করা হয় না, সংকীর্ণ করে ফেলা হয় রাজনৈতিক পরিধিকেও।

গত শতকের ৯০ দশকের ঘটনা। বিএনপি তখন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তরিকুল ভাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ নানা ধরণের মামলা রুজু হয়েছে। তিনি আত্মগোপনে। ঢাকায় এক বাড়ীতে যেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর দেখা পেলাম। মানসিক ভাবে তিনি তখন কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, শারীরিকভাবেও খুব সুস্থ্ না। নানা ধরণের কথাবার্তার পর বললাম,- ক্ষমতায় থেকে এতো যে কোটি কোটি টাকা আয় করলেন সেসব কি হলো?
তিনি একটু চুপ করে থাকলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,- কি যে হলো, এখন সরকারও খুঁজে পাচ্ছে না, আমিও খুঁজে পাচ্ছিনে।


জীবনের সংকটজনক সময়েও যে এ রকম রসিকতা করতে পারে তাঁর থেকে জীবনমুখী মানুষ আর কে হয়?
তরিকুল ইসলাম ছিলেন এমনই।

লেখক: কথাশিল্পি ও প্রাবন্ধিক

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ০২,২০১৮)