দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঋণ প্রদান ও আদায়ে অনিয়মসহ ব্যাংকিং খাতে সব ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতি বন্ধে জোরালো প্রস্তুতি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের সবাইকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে রাখা হবে।

শুধু তাই নয়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ওপর বিশেষ নজরদারি করবে নিয়ন্ত্রক এই প্রতিষ্ঠানটি। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য কয়েকটি তদন্ত (পরিদর্শন) কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আশা করা যায়, ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে। খেলাপি ঋণও কমে আসবে ।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কর্মকাণ্ড তদন্ত করতে এরইমধ্যে তিনটি পরিদর্শন ও একটি তদারক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ‘বিশেষ অডিট’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ একটি অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে,বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের নামে-বেনামে নেওয়া ঋণও খতিয়ে দেখবেন। এছাড়া, সুদ মওকুফ, ঋণ অনুমোদন ও ঋণ অবলোপনসহ পরিচালনা পর্ষদের উত্থাপিত বেশকিছু ফাইল যাচাই-বাছাই করবেন। নিজ ব্যাংকের বাইরে অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেওয়ার ঘটনা খতিয়ে দেখা হবে। ঋণ বিতরণ ও তদারকিতে পর্ষদের ভূমিকাও মূল্যায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এপ্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পর্ষদ যথাযথ ভূমিকা পালন করছে কিনা, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ অনুমোদন, সুদ মওকুফ, ঋণ অবলোপনে কোনও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কিনা, তাও তদন্ত করে দেখা হবে।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিসহ মোট সাতটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নামে-বেনামে নিজ নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিচ্ছেন। এভাবে অনেক ব্যাংকের পরিচালকেরা ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কিন্তু পরে এই ঋণ আর আদায় হচ্ছে না, বরং ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে, তা আদায় দেখানো হচ্ছে। আবার কিছু কিছু গ্রাহকও ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। এতে বেড়ে গেছে ঋণখেলাপির পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপন করা হয়েছে আরও প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, প্রায় এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করা হয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত (তিন বছরে) মোট ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। শুধু গত বছর পুনঃতফসিল করা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৭ এই পাঁচ বছরে ব্যাংকগুলো থেকে ৮৪ হাজার ৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পেয়েছেন খেলাপি গ্রাহকরা।

অনিয়ম ও জালিয়াতির আলোচনায় থাকা তিনটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রথমে বিশেষ পরিদর্শন চালাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক তিনটি হলো— সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক এবং ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক খাতের আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। ওই তিনটি ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান, শীর্ষ পাঁচটি বড় অঙ্কের নবায়ন করা ঋণ, শীর্ষ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ, শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনা করা হবে।

বিশেষ অডিট হবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে

ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকে বিশেষ অডিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরইমধ্যে ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও-দের চিঠি দিয়েছে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

ওই চিঠিতে বলা হয়— সম্প্রতি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে টাকা পাচারের বিষয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এসব ঘটনায় সরকার নিরপেক্ষ অডিট ফার্ম দিয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকার ঘোষিত ব্যবসাবান্ধব আর্থিক খাত সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে সৎ, যোগ্য ও উদ্যোমী ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে, যা বিনিয়োগ ও শিল্প প্রসারকে ত্বরান্বিত করবে।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/মার্চ ১২, ২০১৯)