যশোর-মাগুরা মহাসড়ক। যেন কাল পিচে মোড়ানো নিখুঁত সমতল আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তার দু'ধারে ছোট বড় হাজারো গাছ। দুপাশের গাছের সবুজ ডালপালা একে অন্যের কোলে এসে মিশেছে। দুপাশের সবুজ ভেদ করে ছুটি চলছে গতিশীল বাস, ট্রাক সহ হাজারও বাহন। ছুটে চলা গাড়ির বাতাসে দুলে উঠছে গাছের সবুজ পাতা। চরম আদরে সবুজ পাতাগুলো একে অন্যের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। সড়ক ধরে কিছু দূরে এগিয়ে গেলে ডান দিকে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। হাজার বিঘার কাছাকাছি। গোটা মাঠটাই একেবারে সমতল। যেন সবুজ কার্পেটে মোড়ানো। মাটিও ভীষণ উর্বর। হৃষ্ট পুষ্ট হয় ফসলের প্রতিটি কণা। এ জন্যই মাঠে ধানের রয়েছে আলাদা চাহিদা। মাঠের ধার ঘেষে  বসতবাড়ি। একের পর এক গ্রাম। একদিকে আছে হাশিমপুর, মাঝের গা, ঘুরুলিয়া, মাঠের অপরপ্রান্তে মনোহেরপুর, জোত রহিমপুর, কুতুবপুর, প্রভৃতি সারি সারি গ্রাম।

ইরি মৌসুম। ফসল চাষের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পানি। আশেপাশে খাল নদী না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানি একমাত্র ভরসা। মাঠ জুড়ে বসানো হয়েছে ৬ টি গভীরনলকূপ। নলকূপগুলো দিনরাত পানি তুলে চলেছে। চকচকা ঠাণ্ডা আয়রনমুক্ত, আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি । ভিজিয়ে চলেছে শুকনো ঠন ঠনা মাঠ। এই পানিতে চাষ করে ঘরে তুলছে কাঙ্ক্ষিত ফসল। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর।

কিন্তু গ্রামের মানুষকে গত কয় বছর থেকে একটা নতুন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব । গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় টিউবওয়েল, কিন্তু ইরি মৌসুম শুরু হওয়ার কদিন পর থেকেই শুরু হয় ভোগান্তি। আঙিনার টিউবওয়েল পানি দিতে চায় না। গভীর নলকূপগুলো রাত দিন চলায় পানির লেয়ার (স্তর) নিচে নেমে যেতে থাকে। শুরু হয় মানুষের খাবার পানির কষ্ট। পাড়া মহল্লায় হাতে গোনা দুই একটি টিউবয়েলে পানি পাওয়া যায় তবে পানি তুলতে সহ্য করতে হয় অফুরন্ত কষ্ট। চাপের উপর চাপ দিতে দিতে একটু একটু করে পানি আসে। যা গৃহস্থলি কাজের সার্বক্ষণিক প্রয়োজনের জন্য একেবারে অপর্যাপ্ত।

লেখকের 'সাত শতাংশ সুদ ও কিছু কথা' পড়তে ক্লিক করুন

কথা হচ্ছিলো মোবারক আলীর সাথে। বয়স ৫০ এর কাছাকাছি। কাঁধে সিকা বাক। দু'পাশে দুটি কলস। হেঁটে চলেছেন মাঠের দিকে। কলস নিয়ে কোথায় চলেছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, কি বলবো বাবা, আমাদের খাবার পানি ফসলে খেয়ে নিচ্ছে। আঙিনার টিউবওয়েল পানি দিচ্ছে না। পাড়ার একটি টিউবওয়েল পানি দিত কিন্তু কাল থেকে সেটাও বন্ধ। ডিপ টিউবওয়েলের পানি আনতে যায়।

মোবারক আলী আরও বলেন, আগে যখন স্যালো টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ধান চাষ করা হতো তখন পানির এমন তীব্রতর সমস্যা হয় নি। গভীর নলকূপ বসিয়ে আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের আজ এই ভোগান্তি।
ফসল চাষ যেমন জরুরি তার চেয়েও বেশি জরুরী বিশুদ্ধ খাবার পানি।

বলা হচ্ছে, এক বিঘা জমিতে ইরি চাষ করতে হলে গড়ে প্রায় প্রতিদিন এক হাজার সাতশত গ্যালন পানির প্রয়োজন। ইরি ফসলের জীবনকাল যদি ৯০ দিন হয় তবে প্রায় ৭০ দিন এই পানি প্রয়োজন।
ভাবনার বিষয় হচ্ছে, প্রতিদিন এভাবে কোটি কোটি লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি তুলে ফসল ফলানো হলে সামনের দিনগুলোতে খাবার পানির অভাব তীব্রতর হবে একথা মোবারক আলীর কলস কাঁধে মাঠে চলা দেখেই বোঝা যায়।

আমাদের সরকার বা পানি উন্নয়ন বোর্ড আশু পদক্ষেপ না নিলে দিনে দিনে ভোগান্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। ফসলে খাবে আমাদের বিশুদ্ধ খাবার পানি আর আমাদের নির্ভর করতে হবে বোতলজাত পানির উপর।
আসছি বর্তমান প্রেক্ষাপটে।

'স্কুলে শিশুর ও বাড়িতে মায়ের আর্তনাদ' পড়তে ক্লিক করুন

বর্তমান আন্তর্জাতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক হিসাবে তেলকে বিবেচনা করা হয়।অর্থৎ তেল যায় নিয়ন্ত্রণে, ক্ষমতা তার হাতের মুঠোয়। অনেক বিজ্ঞজনের আশঙ্কা, আগামিতে তেলের স্থান দখল করবে পানি অর্থৎ 'সুপেয় পানি'। এই পানি যার নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতার চাবি থাকবে তার কোমরে। এ কথার যথার্থ প্রমাণও আমরা পেয়েছি। ১৯৭৬ সালের আরব -ইসরাইল যুদ্ধ। যুদ্ধে ইসরাইল জর্দান নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ফলে পুরো আরব ইসরাইল তার হাতের মুঠোয় আসে।

১৯৭৫ সালে আমাদের পরম বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করে। বাঁধের প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেক এলাকা এখন পতনের অপেক্ষায়। ঝকঝকে বালুর উপরে চকচকে সূর্যের তাপ একটা মরুভূমি মরুভূমি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। হালে সেখানকার মানুষ বসতবাড়ি গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। দেশান্তরিত হচ্ছে নতুন বাসস্থানের খোঁজে। বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢেউ এসে লাগছে বড় বড় শহরে। ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে ভেসে যাচ্ছে হাজার মানুষের স্বপ্ন। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানবতা।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির জন্য। এ কথা অনেক আগে থেকে অনেকেই বলে আসছেন।

ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, সতর্ক করে বলেছেন, পানির স্বল্পতা বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, জীবিত মানুষের পানি পাওয়ার অধিক অধিকার থাকা জরুরি এবং এটা হবে ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। উপযুক্ত সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে চরম মূল্য দিতে হবে আমাদের। কারণ তিন বেলা বোতলজাত পানি কিনে খাবার মত আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সরকারকে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসাতে হবে। ফ্রিতে পাওয়া পানি কিনতে হবে সোনার দরে।

লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ১০,২০১৯)