এ.কে.এম মহিউদ্দীন

আজ ২০ রমজান রবিবার , শেষ হচ্ছে মাগফেরাতের দশক। মাত্র ৯ অথবা ১০ দিন বাদে পবিত্র ঈদুল ফিতর। বাকি এই রোজগুলি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পরিপালন করা উচিত। এখানে রাসূলের [সা.] একটি প্রাণস্পর্শী ভাষণ উদ্ধৃত করা গেল। তিনি জাতির উদ্দেশে বলেন, হে মানুষ! নিঃসন্দেহে তোমাদের সামনে রয়েছে আল্লাহর বরকতপূর্ণ মাস। এ মাস বরকত, রহমত বা অনুগ্রহ ও ক্ষমার মাস। এ মাস মহান আল্লাহর কাছে  শ্রেষ্ঠ মাস। নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তি প্রকৃতই দুর্ভাগা বা ভাগ্যাহত যে রমজান মাস  পেয়েও মহান আল্লাহর মার্জনা হতে বঞ্চিত হয়। এ মাসে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মাধ্যমে কিযামত বা শেষ বিচার দিবসের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা স্মরণ কর। অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রদেরকে সাহায্য কর ও সদকা দাও। বয়স্ক ও বৃদ্ধদেরকে সম্মান কর এবং শিশু ও ছোটদেরকে আদর কর। (রক্তের সম্পর্কের) আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা কর। তোমাদের জিহ্বাকে অন্যায্য বা অনুপযোগী কথা বলা থেকে সংযত রাখ, নিষিদ্ধ বা হারাম দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে আবৃত রাখ, যেসব কথা শোনা ঠিক নয় সেসব শোনা থেকে কানকে নিবৃত রাখ। এতিমদেরকে দয়া কর যাতে তোমার সন্তানরা যদি এতিম হয় তাহলে তারাও যেন দয়া পায়।

গুনাহর জন্যে অনুতপ্ত হও ও তওবা কর এবং নামাজের সময় মোনাজাতের জন্যে হাত উপরে তোলো, কারণ নামাজের সময় দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়, এ সময় মহান আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান, এ সময় কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি তা দান করেন, কেউ তাঁকে ডাকলে তিনি জবাব দেন, কেউ কাকুতি-মিনতি করলে তার কাকুতি মিনতি তিনি গ্রহণ করেন।

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের বিবেককে নিজ কামনা-বাসনার দাসে পরিণত করেছো, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একে মুক্ত করো। তোমাদের পিঠ গোনাহর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে, তাই সেজদাগুলোকে দীর্ঘ করে পিঠকে হালকা করো। জেনে রাখ মহান আল্লাহ নিজ সম্মানের শপথ করে বলেছেন, রমজান মাসে নামাজ আদায়কারী ও সেজদাকারীদেরকে জবাবদিহিতার জন্য পাকড়াও করবেন না এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।

হে মানুষেরা! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো মুমিনের জন্য ইফতারের আযোজন করে তাহলে আল্লাহ্‌ তাকে একজন গোলামকে মুক্ত করার সওয়াব বা পুণ্য দান করবেন এবং তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করবেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমাদের মধ্যে সবাই অন্যদেরকে ইফতার করানোর সামর্থ রাখেন না।

বিশ্বনবী (সা.) বললেন, তোমরা নিজেদেরকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা কর, যদিও তা সম্ভব হয়। একটি মাত্র খুরমার অর্ধেক অংশ কিংবা তাও যদি না থাকে তাহলে সামান্য পানি অন্য রোজাদারকে ইফতার হিসেবে আপ্যায়নের মাধ্যমে।

এ পর্যায়ে হযরত আলী (আ.)বললেন, আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, এই মাসে সবচেয়ে ভাল আমল বা কাজ কী? তিনি জবাবে বললেন, হে আবুল হাসান, এই মাসে সবচেয়ে ভাল আমল বা কাজ হল আল্লাহ যা যা নিষিদ্ধ বা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।”

প্রিয় পাঠক, এখন আপনাদের সামনে রাসূল [সা.]এর শেষ দশকের আমল সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

রমযানের শেষ দশকে রাত্রি জাগরণ

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন (রমযানের) শেষ দশক উপস্থিত হত, নবী সাল্লাল্লাহু ‎আলাইহি ওয়া সাল্লাম লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন ও পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে তুলতেন”।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ‎এমন মুজাহাদা করতেন, যা তিনি অন্য সময় করতেন না। ‎

আলি ইবন আবু তালিব রা. থেকে বর্ণিত, নবী [সা]. রমযানের শেষ দশকে নিজ পরিবারকে ‎জাগ্রত করতেন। ‎ ‎

হাদিসটি ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেন, “রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবী ‎সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারের লোকদের জাগাতেন ও লুঙ্গি উঁচু করে নিতেন। আবু ‎বকর ইবন আইইয়াশকে জিজ্ঞেস করা হল, লুঙ্গি উঁচু করে পরার অর্থ কী? তিনি বললেন ,স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ।‎

উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে শিক্ষা ও মাসায়েল

এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের জন্য অধিক পরিশ্রম করতেন, অথচ আল্লাহ তার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন, তবে অন্যান্য রাতের তুলনায় রমযানের শেষ দশকের রাতসমূহে তার পরিশ্রম অধিক ছিল।

দুই. রমযানের শেষ দশকে স্ত্রী-সঙ্গ ত্যাগ করে সালাত, জিকির প্রভৃতি ইবাদতে আত্মনিয়োগ ‎করে বিনিদ্র রাত কাটানো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম আদর্শ। ‎

তিন. রমযানের শেষ দশকের রাতে পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে ইবাদতের জন্য জাগিয়ে তুলা ‎সুন্নত। যদি রমযানে তাদের রাত জাগার অভ্যাস হয়, তাহলে যেন গল্প-গুজব ত্যাগ করে সালাত ও ‎জিকির-আযকারে লিপ্ত থাকে। ‎

চার. গৃহকর্তা স্ত্রী-সন্তানদের উপর নফল ইবাদত আবশ্যক ও তার চাপ প্রয়োগ করতে পারেন, এ ক্ষেত্রে তার আনুগত্য তাদের উপর ওয়াজিব।

পাঁচ. রমযানের শেষ দশকের রাতে সালাত ও জিকিরে মগ্ন থাকা মোস্তাহাব। কারণ তা নবীজীর ‎আমল, উপরের হাদিস তার প্রমাণ। আর সারারাত জাগ্রত থাকার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তার অর্থ সারা বছর রাত জাগ্রত থাকা, তবে যেসব ‎রাতে বিশেষ ফযিলত রয়েছে যেমন শেষ দশকের রাত, তা ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা থেকে ব্যতিক্রম।

ছয়. শেষ দশকের রাতগুলো জাগার উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর সন্ধান করা। আল্লাহর ‎অশেষ অনুগ্রহ যে তিনি লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, যদি সারা বছর তার সম্ভাবনা থাকত, তাহলে তার অনুসন্ধানে অনেকের খুব কষ্ট হত, বরং অধিকাংশ লোক তার থেকে মাহরুম থাকত।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ২৬,২০১৯)