হাসান কবীর

‘ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই,

ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়!’

বাঙালি জাতির পণ্যের মান সম্পর্কে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য একেবারেই খাঁটি কথা বলেছেন।
উদাহরণ দেই, বাংলাদেশের সরকারি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট বা বিএসটিআই শখের বশে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

রমজান মাস শুরুর আগে খোলা বাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআই। সবগুলোই একেবারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। যেগুলোর উপর সকাল বিকাল আমাদের নির্ভরতা। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সরিষার তেল, চিপস, খাবার পানি, নুডলস, হলুদ ও মরিচের গুঁড়া, আয়োডিন যুক্ত লবণ, লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, বিস্কুট এবং ঘি। এসব পণ্যগুলো দেশের স্বনামধন্য বিখ্যাত কোম্পানির উৎপাদিত। যে সব পণ্যগুলো আমরা একেবারে চোখ বন্ধ করে, বাম বুকে ডান হাত রেখে, নিশ্চিন্ত মনে দীর্ঘদিন থেকে চেটেপুটে ভোগ করে আসছি আর খাঁটি আমেজের তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বিএসটিআই এর শখের খেলায় ভয়াবহ রকমের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যা দেখে সাধারণ-অসাধারণ সকল রকমের ভোক্তাদের পিলেই চমকে উঠেছে। ছোট বড় সকলের চোখ একেবারেছানাবড়া।

সংগ্রহীত ৪০৬টি পণ্যের নমুনা মধ্যে ৫২টি পণ্যের মানের অবস্থা ভীষণ রকমের নাজুক। ল্যাব পরীক্ষায় সরাসরি অকৃতকার্য। কোন কোন পণ্যের মানের অর্জিত নম্বর একেবারে শূন্যের কোঠায়। ভাবতে অবাক লাগে, চোখ ধাঁধানো মোড়কের হলুদ গুঁড়ায় হলুদের কোন অস্তিত্ব নেই !! অন্য কিছুকে হলুদ সাজিয়ে দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছেন। আমরাও মহাসমারোহে হলুদ ভেবে রকমারি খাবারে ব্যবহার করে আসছি। মরিচেরও একই হাল। মরিচের গুড়ার সাথে মিশে আছে মিহি ইটের গুড়া। সরিষার মধ্যেও ভুত, তেল দেখতে ঘানি ভাঙ্গা তেলের মতো, চরিত্রে একেবারে নাক ভাঙ্গা ঝাঁঝ। কিন্তু তেলের উৎস মটেও সরিষা নয় !
নামকরা ব্রান্ডের আয়োডিন যুক্ত লবনে কোন আয়োডিনের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু লবণ উৎপাদনে সরকারের সহায়তা ঠিকই আছে। আমরা এসব মিহি দানার দুধ সাদা লবনের চোখ ধাঁধানো প্যাকেটের কাছে সকাল-বিকাল প্রতারিত হচ্ছি। তিন গুণ দামে এই লবন কিনছি। চোখেমুখে আয়োডিন যুক্ত লবনের খাঁটি আমেজ নিয়ে বাড়িতে আসি। পরিতৃপ্তির রগরগে কন্ঠ নিয়ে গিন্নির কাছে আয়োডিনযুক্ত লবনের গল্প করি। ভাবতে অবাক লাগে, আয়োডিনযুক্ত লবনের গল্পটা পুরোটাইবোগাস ! গোটাটায় একটা গাঁজাখুরে গল্প।
সাধারণ ভোক্তাদের সাথে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের এ কেমন নির্মম রসিকতা ? নিত্য ভোগ্যপণ্য নিয়ে এমন শতভাগ প্রতারণা পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তরে, অন্য কোন দেশে আছে কিনা তা অজানা।

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের জারীকৃত অধ্যাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ স্ট্যন্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (BSTI) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএসটিআইপণ্য ও সেবার মান প্রণয়ন এবং গুণগতমান ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণসহ এতদসংশ্লিষ্ট সেবাসমূহকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের পাশাপাশি ভোক্তা স্বার্থ রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন হলো, জন্মের পর থেকে বি এস টি আই তার লক্ষ্যের দিকে কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে ? সারাদেশে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই কি কাঙিক্ষত ভূমিকা রাখতে পেরেছে ?
আমরা হরহামেশাই দেখছি, সাধারণভোক্তা এক কেজি মিষ্টি কিনে গর্বের সাথে বাড়িতে ফিরছেন। তার গর্বকে খর্ব করে দোকানী মুখ টিপে চাপা হাসি হাসছেন। কারণ ?তাকে তিন পোয়া মিষ্টি আর এক পোয়া ওজনের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে।এ তো গেলো ওজনের দিক। মিষ্টির গুনগত দিক আরও ভয়াবহ রকমের খারাপ।
বড় বড় নামকরা কোম্পানির মিষ্টির মধ্যে ছোট-বড় হরেক রকমের তেলাপোকা চাষ, টিকটিকির লেজের নড়াচড়াও আছে। একবার ভাবুন তো,পণ্যের গুণগত মানের অধঃপতন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ?

তবে বাঙালির পেট, হজম ক্ষমতাকে বাহ্ বাহ্ দিতেই হবে। একেবারে লোহা খেয়ে রড বের করার মতো। এতো কলুষিত, এতো দূষিত খাবার খেয়েও দিব্যি টিকে আছে। এ যেন আরএফএলের পাকস্থলী। যা এত সহজে বিগড়ে যাবার নয়।

তবে বলতেই হবে, আমরা আজব দেশের বাসিন্দা। এদেশে খাঁটি গরুর দুধে তরতাজা টেংরা মাছ মেলে। কিন্তু কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। আইসক্রিমের মধ্যে মেলে আস্ত ব্যাঙ। বাহারি রঙের বরফের সাথে চার হাত পা চারদিকে দিয়ে লেপ্টে আছে।তারপরও সেই ব্রান্ডের আইসক্রিম আমরা নিঃসংকোচে এপিঠ ওপিঠ করে চেটেপুটে খেয়ে চলেছি। মুখে উচ্চারণ করছি স্বাদে গন্ধে একেবারে জাক্কাস !
নামকরা ব্র্যান্ডের ম্যাংগো জুসের প্যাকেটে প্রকৃতির লাঙ্গল বলে খ্যাতকেঁচোর বসবাস। আমের বদলে কুমড়োর মিকচার। সাথে কৃত্রিম রং আর গন্ধ। এত কিছু আমাদের খাঁটি বাঙালি রুচিবোধকে এতটুকুও টলাতে পারেনি। কারণ একটাই, আমরা যে খাঁটি বাঙালি !! ভেজাল নিজেই আমাদের কাছে পরাজিত। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা তো আলকাতরা খেতেও অভ্যস্ত !!

কিন্তু প্রশ্ন হলো,বিএসটিআই সারাবছর কেন নিশ্চুপ ? এ সমস্ত পণ্য সারা বছরই চোখের সামনে হরহামেশাইবাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে কেন বছরের বিশেষ সময় এই শুদ্ধি অভিযান ? কেন এইসব সিন্ধু চোরদের লোক দেখানো বিন্দু বিন্দু জরিমানা ?
বছরের পর বছর ধরে যারা এসমস্ত ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে সাধারন পাবলিকের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে শত শত কোটি টাকার মুনাফা লুটে নিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে তাদের শাস্তি কি হতে পারে ?শুধুই কি নাম মাত্র কিছু টাকা জরিমানা বা লোক দেখানো পণ্যের লাইসেন্স বাতিল, এই এতোটুকুই ? সাধারণ ভোক্তাদের সাথে এটা একটা নির্মম রসিকতা।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রতারিত করে যে সকল প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। রাতারাতি মুনাফার পাহাড় তৈরি করে ফেলছে। তাদের অবৈধ টাকার পাহাড়কে গুড়িয়ে দিতে হবে। ভেজাল তেল,ভেজাল সেমাই খেয়ে যে লোকগুলোর আজ কম্ম সারা,কেউবা পেটের পীড়া পীড়িত,আবার কেউ হার্টের রোগী হয়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে নিঃস্ব হচ্ছেন। তাদের স্বাস্থ্যের এ অবস্থার জন্য একমাত্র ভেজাল পণ্য দায়ী। এ সমস্ত ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণদিতে হবে। ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণন থেকে অর্জিত কাঁড়ি কাঁড়ি অবৈধ মুনাফা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে।


প্রতিটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে শুধু মানসম্মত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। তবে কেন তারা ভেজাল নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন করবে ? তাদের এই ইচ্ছাকৃত নিম্নমানের পণ্য উৎপাদনের অর্থ দাঁড়াই,উক্ত প্রতিষ্ঠানের সমস্ত মুনাফা অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। এ সব অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থের মালিক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। এসব রাঘববোয়ালদের যতই মাথা মোটা হোক না কেন তাদের বিষদাঁত অবশ্যই ভেঙ্গে দিতেহবে। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে আইনের শিকলে তাদেরকে বাঁধতে হবে। বিজ্ঞ আদালতে বিষয়টি ভেবে দেখবেনআশাকরি ।

ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের জন্য বিএসটিআই কে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা বলা যাবে না, এর জন্য দায়বদ্ধতাও একেবারে কম নয়। বিএসটিআই ঠিকঠাক মতো তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে । তবে আমরা দেখছি কোন অজানা কারণে বিএসটিআই নিয়মিত ভেজাল বিরোধী অভিযানও পরিচালনা করতে পারে না। এ বিষয়ে হয়তো বিএসটিআই মুচকি হেসে, নরম সুরে জবাব দেবেন, আমাদের অতো লোকবল কোথায় যে রাতদিন এত ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করব ? পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে প্রতি জেলায় অফিসও পর্যন্ত নেই। ল্যাব টেস্টিং ব্যবস্থাও প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, যতটুকু সামর্থ্য আছে তার দ্বারা অনেক অপরাধী কে আটকানো সম্ভব। নির্ভেজাল খাদ্য যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে না পারলে অতি শীঘ্রই গোটা জাতি একটি রুগ্ন জাতিতে পরিণত হবে। যাদের প্রতিনিয়ত সকালে পেটের পীড়ার, রাতে মাথা ব্যথার পিল সেবন করতে হবে। যারা স্বাস্থ্য জল হস্তি, আর বুদ্ধিতে গাধার আকার নিবে। একেবারে অথর্ব টাইপের।দুবেলা ভাতের প্রয়োজনের চেয়ে ওষুধের প্রয়োজন পড়বে আগে। নিশ্চয়ই আমরা এমন জাতি কিছুতেই আশা করতে পারি না।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মে ২৬,২০১৯)