রোকেয়া আশা

(পূর্ব প্রকাশের পর) " বাসনগুলা ধুইয়া রাখ তো মা। "
বড়মামীর কথায় আফসানা ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলে। মুখে কোন কথা বলে না। এমনিতেই সে কথা কম বলে। মা মারা যাওয়ার পর মামাবাড়িতে আসার পর থেকে তার কথা বলা আরও কমে গেছে।
নিঃশব্দে এঁটো থালাবাসনগুলো তুলে নিয়ে কলপাড়ে চলে যায়। 
মানুষ বয়স থেকে না, অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। আফসানার ছোট্ট জীবনেই পরিবারের ভাঙন চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর যখনই তার ভাইকে রেখে তাকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখনই আফসানা বুঝে গেছে ; মা না থাকলে মামার বাড়িও আসলে পরের বাড়ি। এখানে এখন কোন ঝামেলা ছাড়া টিকে থাকতে হলে ঘরদোরের কাজ করেই থাকতে হবে। যদিও এখানে কেউ আফসানার সাথে এখনো পর্যন্ত গলা উঁচু করেও কথা বলে নি ; কিন্তু অবস্থা পাল্টাতে কতক্ষণ।

" আপু, আমি কল চাইপা দেবো? "
আফসানা মাথা তুলে দেখে ইসরাত। আফসানার মামাতো বোন। বয়সে আফসানার চেয়ে বছর দুইয়ের ছোট হবে।
" না ইসুমনি। তুমি ঘরে যাও। আমি নিজেই চাইপা নিতে পারবো। "
ইসরাত তবুও যায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। স্বল্পভাষী আফসানাও আর কথা বাড়ায় না। এটো থালাবাসনগুলো ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ঘষতে থাকে একমনে। যখনকার ঘটনা, তখন গ্রামেগঞ্জে ভিমবারের মত ডিশ ওয়াশিং বারের তেমন প্রচলন ছিলো না। গ্রামের সাধারণ ঘরের থালাবাসন মাজার জন্য চুলা থেকে তোলা ছাইই ভরসা ছিলো। আফসানার মামারা মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন। তারা ছাইয়ের বদলে কাপড় ধোয়ার গুড়ো সাবান ব্যবহার করেন বাসনকোসন ধোয়ার জন্য।

" আপু, তুমি তো আইসোই, নিজাম কি ওইবাড়িত একলাই থাকবো? "
ইসরাতের প্রশ্নের সহসাই কোন উত্তর দিতে পারে না আফসানা। ভাইয়ের কথা যে তার মনে পড়ে না তা নয়, কিন্তু সেই বা কি করতে পারে।
" একলা আর কই, আব্বা তো আছেই ওর লগে। "

মুখে কথাটা বললেও মেয়েটা মনে ঠিক ভরসা পায় না। বাবাকে যমের মত ভয় পায় দুই ভাইবোনই। এতদিন পক্ষীশাবকের মত করে ওদের দুজনকে ডানার ভেতর আগলে রেখেছিলো এক নারী। মা। আজ তিনিই আর নেই। নিজাম বাচ্চা মানুষ। কিভাবে বদমেজাজী বাবার সাথে আছে কে জানে!
ভাইটার কথা মনে পড়লেই আফসানার খুব কষ্ট হয়, মায়া লাগে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে কত বাছবিচার ছেলেটার। খেতে বসলে তরকারি থেকে পেঁয়াজ মরিচ সব খুঁটে খুঁটে ফেলে তবে খায়। আব্বা নিশ্চয়ই এখন এসব প্রশ্রয় দেবে না। আফসানা নিজে বাড়িতে থাকাকালীন কতবার যে আব্বার রাগারাগি থেকে নিজামকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মার খেয়েছে তার হিসাব নেই। এখন বাড়িতে ওদের মা নেই, আফসানা নিজেও নেই। এখন যদি ওদের বাবা নিজামকে রেগে গিয়ে মারধোর করে তাহলে ঠেকানোরও কেউ নেই৷ বাসনগুলো মাজা শেষ করে মুখ তুলে তাকায় আফসানা। ইসরাত যায়নি এখনো।

" ইসু তুমি সরো তো আপু। আমি নিজেই চাইপা নিতে পারবো। "
বড়বোনের কথা শুনে একটু সরে দাঁড়ায় ইসরাত। আফসানা ভেজা হাতেই কলের ডান্ডিটা চেপে ধরে।
ওরা দুইবোন যখন টিউবওয়েলের পাশে তখন ভেতরবাড়িতে আফসানার বড়মামা ঘরে এসে বসেছে।
" আফসানা কই? "
ঘরে ঢুকেই আফসানার বড়মামা জালাল উদ্দীন স্ত্রীকে প্রশ্ন করেন।
" ও তো কলপাড়ে গেসে, বাসন ধুইতে। "
" ক্যান? অয় ক্যান বাসন ধুইবো? মাইয়াডার মা মরসে দেইখা কি অর আর কেউ নাই? অরে দিয়া তুমি এহনই কামলা খাডানো শুরু করসো? "

আফসানা ও নিজামের বড়মামী ফাতেমা বেগম অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকেন। আফসানা মেয়েটাকে তিনি ভালোই বাসেন। আজকে কোমরের পেছনে ব্যথাটা বেড়েছে বলেই শুধু আফসানাকে থালাবাসন কয়টা ধুয়ে দিতে বলেছিলেন ; ইসরাত ছোটমানুষ। নাহলে তো ইসরাতকেই বলতেন।
ফাতেমা বেগম বুদ্ধিমতী। পুরুষ মানুষের যখন রাগ হয় তখন যে তাদেরকে কোন কৈফিয়ত দিয়ে ঠাণ্ডা করা যায় না তা তিনি জানেন। এইরকম সময়ে সংসারে শান্তি বজায় রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজের দোষ কবুল করা।

ফাতেমা বেগম মাথা নিচু করে বলেন,
" ভুল হইয়া গেছে। আমি এহনি যাইতাছি। মাজায় বেদনা করে তো, পিড়ি হইয়া বসতে পারি না। "
দাওয়ায় কাজ হলো। জালাল উদ্দীন নরম হয়ে বললেন,
" থাক। অহন গিয়া কাম নাই। বসো ইকটু। জরুরি কতা আছে।"
ফাতেমা বেগম চৌকিতে স্বামীর পাশে বসেন। শাড়ির আঁচলটা মাথার দিকে আরেকটু টেনে নেন। বেশভূষা ঠিক করার জন্য না। স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। ফাতেমা বেগমের বয়স কম। দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী। স্বামীকে সবসময় হাতে রাখার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তারপরও এসব বাড়তি ছলাকলা করাটা ভালো। ঘরের বউ যেমন আটপৌরে হয়ে থাকে, তেমনটা থাকলেই আসলে পুরুষ মানুষের ঘর থেকে মন উঠে যায়। বউ যদি প্রেমিকার মত থাকে, তাহলে ঘরের পুরুষটাকে বেঁধে রাখার জন্য বাড়তি কিছু লাগে না।
জালাল উদ্দীন স্ত্রীকে ভালোবাসেন। ফাতেমা বড় ভালো মেয়ে। আর দশটা বউয়ের মত সারাদিন কুটকাচালিতে ব্যস্ত থাকে না। এই যে আফসানা এবাড়িতে এলো, ফাতেমা তো কই অন্য মামীদের মত এই নিয়ে কোন ফ্যাসাদ করে নি। বড় ভালো মানুষ ফাতেমা।

" আফসানার বাপে আবার বিয়া করসে। "
জালাল উদ্দীনের কথাটা শুনে ফাতেমা বেগম ভীষণ চমকে ওঠে।
" কি কন এইডা! বউ মরলো কয়দিন হইসে? এরমইদ্দেই আরেকটা বিয়া কইরা ফালাইলো? "
" তারে আর দোষ দিমু না। সেয় ব্যাটা মানুষ। বাড়িতে আর কুনু মাইয়ালোক নাই। আফসানা তো পোলাপান মানুষ। এত বড় গিরস্থি, ঘরদোর, পোলাপান - সব সামলানির লাইগা তো ঘরে মাইয়া মানুষ থাকার দরকার আছে। "
" তা ঠিক আছে। কিন্তু আপার তো চল্লিশাও মিটে নাই অহনো। "
জালাল উদ্দীন স্ত্রীর কথা শুনে মুখ কালো করে ফেললেন।
" ইসরাতের মা শুনো, দুলাভাই কেমুন মানুষ আমরা বেবাকেই জানি। কিন্তুক, আমি তোমারে আসল কামের কথাডা অহনো কই নাই৷ "
ফাতেমা বেগম সকৌতুহলে তাকিয়ে থাকে। জালাল উদ্দীনের কথাটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে।
" আফসানা এইহানেই থাকবো। নিজামরে দুলাভাই তাগো বাড়িতেই রাখবো৷ চিন্তার কিছু নাই। আফসানার লাইগা মাসের খরচা দুলাভাইই দিবো। "
ফাতেমা বেগম ছোট করে একটা শ্বাস ফেলেন। তিনি নিজে সৎমায়ের সংসারে মানুষ। তার ননদ মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য তার যে গভীর মমতার জন্ম হয়েছে তার উৎসও হয়তো নিজের দুঃসহ শৈশব।
" আপনেরে আমি খরচের কথা জিগাইসি? এই দুই আনি মাইয়া আমাগো এমন কি খাইয়া উজার করবো? অয় থাহুক। ইসরাতের লগে থাহুক। "
ফাতেমা বেগমের ভেতরে তখনও খচখচ করতে থাকে। সংসারে বাড়তি একটি প্রাণি যোগ হওয়ার জন্য না, ছোট্ট নিজামের জন্য। বাচ্চাটা সৎমায়ের সংসারে পড়েছে। কথায় বলে মায় মরলে বাপে তালুই। এরকম কিছু যদি নিজামের সাথেও হয়?

তাদের স্বামী স্ত্রীর আলাপে ছেদ পড়ে কলপাড় থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দে।
দুজনে তখন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছুটে যান কি হয়েছে দেখার জন্য।
তারা যখন কলের পাড়ে এসে পৌঁছান, আফসানা তখন দুহাতে নিজের নাকটা চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। একটা মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থেকেই মেয়েটার চোখ উল্টাতে শুরু করে। ফাতেমা বেগম ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে ফেলেন। জালাল উদ্দীন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে দেখেন আফসানা বেহুঁশ অবস্থায়ও নাক থেকে হাত সরায় নি। ওর হাতের ফাঁক দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। (ক্রমশ)

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুন ০৯,২০১৯)