দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বিএনপি নেতাদের দুই গ্রুপের ‘রেষারেষি’র কারণে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনে সংকট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান।

ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রিজভী গ্রুপের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার ছাত্রদল কমিটির সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান। আর আমান গ্রুপ চায় সদ্য বিলুপ্ত কমিটির ‘বয়স্ক’ নেতাদের মধ্য থেকে দুজনকে ছাত্রদলের শীর্ষ এই দুই পদে দেখতে। ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ায় সংগঠনটির নতুন কমিটি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

রুহল কবির রিজভীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপে রয়েছেন, তারেক রহমানে সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রবিকুল ইসলাম বকুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। এছাড়া, এই গ্রুপের বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলও রয়েছেন। তবে তিনি বর্তমানে কারাগারে থাকায় তার অনুসারীরা কাজ করে যাচ্ছেন।

আমান উল্লাহ আমানের নেতৃত্বীন গ্রুপে আছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালা উদ্দিন টুকু। যদিও টুকু বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাদের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক ব্যবসায়ী নেতাও রয়েছেন।

বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, রিজভী গ্রুপ ছাত্রদলের আগামী কমিটির শীর্ষ ২ পদে আনতে চায় ঢাবি শাখা ছাত্রদলের কমিটির সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমানকে। এজন্য তারা ছাত্রদলের আগামী কাউন্সিলে কেবল ২০০০ সাল-পরবর্তী যেকোনও বছরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাবিষয়ক নিয়ম করিয়ে নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে। এই সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছেন রিজভী ও বকুল। যেন বর্তমান কমিটির কেউ প্রার্থী না হতে পারেন। কারণ, তাদের দুই প্রার্থীর মধ্যে মেহেদী (২০০০) ও হাফিজুর রহমান (২০০১) সালে এসএসসি পাস করেছেন। যদিও মেহেদী বিবাহিত বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে রুহল কবির রিজভীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের নেতা আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল বলেন, ‘ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় সার্চ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে আলাদাভাবে কোনও পরামর্শ দেওয়া সুযোগ ছিল না। বিএনপি থেকে ছাত্রদলের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কোনও গ্রুপ নেই। যারা ছাত্রদলের আগামী কমিটির জন্য প্রার্থী হবেন, তারা সবাই দলের প্রার্থী।’

রিজভী গ্রুপের পছন্দে থাকা ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, ‘আমি ছাত্রদলের আগামী কমিটিতে প্রার্থী হবো। যাদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাই আমাকে বিবাহিত বলে বদনাম ছড়াচ্ছেন। আমি বিবাহিত নই। আর আমি কোনও বলয় বা গ্রুপের প্রার্থী নই। আমার নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, ‘রুহল কবির রিজভীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের নেতা রবিকুল ইসলাম বকুলের বাড়ি খুলনায়। তার এলাকায় হাফিজুর রহমানের বাড়িও। এ কারণে তিনি চান, ছাত্রদলের আগামী কমিটিতে হাফিজুর রহমানকে নেতা করতে। তারেক রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ছাত্রদল নিয়ে অনেক বিষয়ে ভুল বোঝাচ্ছেন তিনি।’

ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, আমান উল্লাহ গ্রুপ চায় ছাত্রদলের কমিটি গঠনের বয়সসীমা না করে কাউন্সিল করতে। যেন ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির ‘বয়স্ক’ নেতারাও প্রার্থী হতে পারেন। এই ক্ষেত্রে বর্তমান কমিটির একাধিক নেতা তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন।

বিএনপির একটি অংশের অভিযোগ, গত ১১ জুন থেকে বয়সসীমা না করে ছাত্রদলের ধারাবাহিক কমিটি গঠনের দাবিতে সদ্য বিলুপ্ত ছাত্রদলের কমিটির নেতাদের আন্দোলনে আমান উল্লাহ গ্রুপের উসকানি রয়েছে। তাদের আন্দোলনকে পুঁজি করে রুহুল কবির রিজভীকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকেও বের করতে চান তারা। এজন্য তারা ১১ জুন বিএনপির কার্যালয়ে তালা দিয়ে ভবনের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অসুস্থ রিজভীকে বের করতে অ্যাম্বুলেন্সও নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত কার্যালয় থেকে বের হননি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আমান উল্লাহ আমান গ্রুপের নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ‘ছাত্রদলের চলমান সংকটের কোনও সমাধান এখন পর্যন্ত হয়নি। আশা করি, আগামী ১-২ দিনের মধ্যে এর একটা সমাধান হয়ে যাবে। পার্টির হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে।’

ছাত্রদলের চলমান আন্দোলন ও রিজভীকে কার্যালয় থেকে বের করার চেষ্টার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এ্যানী বলেন, ‘দুই-একজন না বুঝে এসব এসব অভিযোগ করছেন। আর আমাদের কোনও গ্রুপ নেই।’

প্রসঙ্গত, নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে গত মার্চ মাসে ছাত্রদলের কমিটি করতে সাবেক ছাত্র নেতাদের দিয়ে একটি সার্চ কমিটি করে দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সার্চ কমিটির নেতারা হলেন—বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রু কবির খোকন, বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, বিএনপির তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব, বর্তমান ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান।

বিএনপি-সূত্র জানায়, মার্চে সার্চ কমিটি হলেও কোন প্রক্রিয়ায় ছাত্রদলের কমিটি হবে—এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা। কারণ সার্চ কমিটি দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল। যে কারণে গত ৩ জুন রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলে করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে ৩টি কমিটিও করা হয়। কিন্তু ১১ জুন থেকে বয়সসীমা রেখে কমিটি গঠনের দাবিতে আন্দোলনে শুরু করে বিলুপ্ত কমিটির বড় একটি অংশ। যার ফলে কাউন্সিলের তারিখ এখনও ঘোষণা করতে পারেনি বিএনপি।

ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব বাছাই কমিটিতে আছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন। কবে কাউন্সিল হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিল করার টার্গেট রেখে কাজ করে যাচ্ছি। তবে কোনও কারণে করতে না পারলে সময় বাড়াতে হলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো। তবে এখনও নির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারছি না।’

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জুন ১৯,২০১৯)