দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য বড়ছড়া রেলসেতু নয়, অন্য চারটি কারণকে চিহ্নিত করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে এজন্য গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি। এ চারটি কারণ হচ্ছে লাইনের দুর্বলতা, চাকার কম্বিনেশন, দ্রুত গতিতে ট্রেন চালনা এবং ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেইন জানান, লাইনের দুর্বলতা কিংবা চাকার কম্বিনেশনের কারণে ঘটতে পারে এ দুর্ঘটনা। তিনি জানান, একটি ট্রেনে সচরাচর ১২-১৪টি বগি থাকে। কিন্তু, দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটিতে বগি লাগানো হয়েছিল ১৭টি। প্রতিটি বগিতে সিট ছিল ৬৫টি। এ হিসাবে ট্রেনটিতে প্রায় ১ হাজার ১০৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর বাইরে আরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন।

রেলওয়ে সচিব জানান, দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের সর্বশেষ বগি বড়ছড়া রেলসেতুর নিচে পড়ে যায়। পরে দুটি বগি উল্টে যায় এবং এর পরের দুটি বগি রেলে দাঁড়ানো অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে।

সচিব জানান, তদন্তকারীরা দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন এবং ব্রিজের (রেলসেতু) ছবি নিয়ে গেছে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৮শ’ গজ রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বগাছড়া রেলসেতুর কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে যাত্রীসহ অনেকেরই ধারণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই এ বিষয়ে মন্তব্য করছেন। রেলওয়ে কুলাউড়ার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো.জুয়েল আহমদের কাছে এ রেলসেতুর কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,এ কারণে ঘটেছে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, বড়ছড়া ব্রিজটি (রেলসেতু) অনেক দিন আগে নির্মিত হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনা ব্রিজের কারণে নয়,লাইনে ত্রুটির কারণে ঘটতে পারে তার ধারণা। তিনি জানান, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল এবং স্প্রিংগুলো ছিল অনেক পুরাতন। দুর্ঘটনার পেছনে এটাও কারণ হতে পারে।

কুলাউড়ার ইউএনও মো. আবুল লাইছও ট্রেনটিতে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল বলে এ প্রতিবেদককে জানান।

স্থানীয় বরমচাল গ্রামের বাসিন্দা জাকারিয়া আলম জানান, সিলেট-ঢাকা রেল রুটের মোগলাবাজারে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর কালনি এক্সপ্রেসকে পার হওয়ার সুযোগ দিতে (ক্রসিং ) উপবন এক্সপ্রেসের প্রায় আধা ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। ফলে সময়ের এ ঘাটতি পোষাতে চালক ট্রেনটি দ্রুতগতিতে চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পেছনে এটা অন্যতম কারণ হতে পারে বলে জানান জাকারিয়া।

এ বিষয়ে রেল সচিব বলেন, এটা তদন্ত কমিটি বলতে পারবে।

প্রত্যক্ষদর্শী বরমচাল স্টেশনের চা দোকানি ফারুক মিয়া জানান, ‘খুব স্পিডে ট্রেনটি চালানো হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়। এটা শুনে এলাকাবাসী উদ্ধার তৎপরতায় নেমে পড়েন।’

দুর্ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা অভিযোগ করেন, রেল লাইনের স্লিপারের নাট-বল্টু, হুক-ক্লিপ একেবারে ঢিলা হয়ে গেছে। কাঠের স্লিপারগুলোও ছিল দুর্বল। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা বিরাজমান থাকলেও এগুলো সংস্কারের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

রবিবার রাতে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেল সচিব মো.মোফাজ্জেল হোসেন ও রেলওয়ের ডিজি কাজী রফিকুল আলমসহ পদস্থ কর্মকর্তারা বিশেষ ট্রেনে করে ঘটনাস্থলে আসেন।সোমবার ভোরে তারা কুলাউড়ায় পৌঁছেন। তারা দিনভর সেখানে অবস্থান করে উদ্ধার তৎপরতা তদারকি করেন।

যাত্রীদের বর্ণনা

দুর্ঘটনা কবলিত বগির যাত্রী সুনামগঞ্জ সদরের পইদা গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার আগে ট্রেনটির স্পিড হঠাৎ বেড়ে যায়। এরপর ট্রেন থেকে বগি ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনায় তার মাথা ফেটে যায়।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের বাসিন্দা ফজলুল হক জানান,তিনি ৭ নম্বর বগিতে ছিলেন। হঠাৎ ট্রেনের ৫টি বগি উল্টে গেলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের যাত্রী সিলেটের ব্লু বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ইমরান আহমদ, রবিরবাজারের বাসিন্দা এআইইউ এর ছাত্র আহমদ তোফায়েল, কাদিপুরের পলাশ ও নোয়াখালির ফাতেমা আক্তার আনু জানান, ট্রেনটি একবার দ্রুতগতিতে,একবার ধীর গতিতে চলছিল। বরমচাল স্টেশন প্রবেশের সময় ট্রেনটির গতি ছিল সর্বোচ্চ।

আহতদের চিকিৎসা

কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ দুর্ঘটনায় আহত ৬৮ জনকে এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল দুটির সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

নিহতদের পরিচয়

মনোয়ারা পারভিন (৪৮) স্বামী আব্দুল বারি, গ্রাম কাদিপুর,কুলাউড়া; ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০), পিতা আব্দুল বারী, গ্রাম-আব্দুল্লাহপুর, জালালপুর দক্ষিণ সুরমা, মোগলাবাজার; সানজিদা আক্তার (২০), পিতা আক্রাম মোল্লা, ভাঙ্গারকোলা,মোল্লার হাট, বাগের হাট এবং কাউছার আহমদ,পিতা-নূর হোসেন, দরমন্ডল,থানা কুরাইতলা,মাধবপুর,ব্রাক্ষণবাড়িয়া।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জুন ২৪, ২০১৯)