দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রাজধানীর কাফরুল থানাধীন সেনপাড়া পর্বতায় ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী বাবার দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন মো. সুমন খান (২৬)। ঘটনার পরদিন শিশুটির বাবা কাফরুল থানায় মামলা করতে গেলে দায়িত্বরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কুদ্দুস বেপারি টাকা দাবি করেন।

এসআই শিশুটির বাবাকে বলেন, ‘টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া মামলা চালানো সম্ভব নয়।’ দরিদ্র ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী বাবার কাছ থেকে চার হাজার টাকা আদায় করেন তিনি।

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর চরম সমালোচনার মুখে পড়েন ডিএমপির কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আব্দুল কুদ্দুস বেপারি। টাকা নেয়া-সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড ফাঁস এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর ওই এসআইর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠে।

এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসআই আব্দুল কুদ্দুসকে প্রত্যাহার করে মিরপুরের উপ-কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। তদন্তে অপেশাদার আচরণ ও টাকা নেয়ার ঘটনায় শাস্তি পেতে যাচ্ছেন এসআই আব্দুল কুদ্দুস।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কাফরুল থানা পুলিশ ও মিরপুর বিভাগ পুলিশ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গত ২১ মে ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী বাবার দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন মো. সুমন খান। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ভুক্তভোগী শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। উত্তেজিত জনতা ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত সুমনকে ব্যাপক মারপিট করেন। অসুস্থ অবস্থায় ওই যুবককে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

পরদিন ২২ মে রাতে ওই শিশুর বাবা মোজাম্মেল হাওলাদার কাফরুল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশের দায়িত্বরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কুদ্দুস বেপারি টাকা দাবি করেন। তিনি বলেন, টাকা লাগবে। টাকা ছাড়া মামলা চালানো সম্ভব নয়। দরিদ্র ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চার হাজার টাকা আদায় করেন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গ্রেফতার সুমনের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করেন। মামলা নং- ৩২। ওই মামলার তদন্তভারও থানা থেকে ন্যস্ত করা হয় তার ওপর।

বিষয়টি জানার পর একই এলাকার বাসিন্দা ও ‘সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি’ নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান আনোয়ার-ই-তাসলিমা প্রথা ফোনে কথা বলেন ওই এসআইয়ের সঙ্গে। তিনি থানায় উপস্থিত হয়ে চাপ প্রয়োগ করে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেন। অভিযুক্ত এসআই টাকা ফেরত দেন ২৩ মে রাতে।

এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার (৮ জুলাই) বিকেলে ওই ধর্ষণ চেষ্টার মামলার বাদী মোজাম্মেল হাওলাদার বলেন, ‘হ্যাঁ আমার কাছ থেকে কুদ্দুস নামের এক এসআই চার হাজার টাকা দাবি করে নিয়েছিলেন। মেয়ের ওপর নির্যাতনের বিচারের আশায় মামলা নথিভুক্ত করতে ওই টাকা দিয়েছিলাম। এলাকাবাসীর মারধরের কারণে ধর্ষক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার চিকিৎসা বাবদ টাকা লাগবে বলে ওই এসআই টাকা দাবি করেছিল।

তিনি বলেন, আমার একই এলাকার বাসিন্দা প্রথা আপা বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি প্রথমে ফোনে কথা বলেন এবং পরে থানায় গিয়ে ওই এসআইয়ের কাছ থেকে টাকা আদায় করে দেন।

মোজাম্মেল হোসেন আরও বলেন, ‘পরিচিত দু-তিনজন ঘটনাটি দেখে ফেলায় ওই যাত্রায় আমার মেয়ে বেঁচে গেছে। আমি ধর্ষণচেষ্টাকারীর বিচার চাই। তবে মামলা করতে গিয়ে যে টাকা দিতে হবে, এটা ভাবিনি।’

ওই ঘটনায় এসআই কুদ্দুস বেপারির সঙ্গে আনোয়ার-ই-তাসলিমা প্রথা নামে ওই মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যানের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। সেখানে এসআইকে তিনি বলেন, ‘…রাতে সুমনের ছোট আট বছরের বাচ্চার ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় মামলা কি হয়েছে? এসআই কুদ্দুস বলেন, হ্যাঁ মামলা হয়েছে।’

প্রথা বলেন, কিন্তু ওদের কাছ থেকে রাতে চার হাজার টাকা নিছেন কেন? এরা গরিব মানুষ। টাকাটা কি খরচের জন্য নিছেন?

এসআই কুদ্দুস প্রত্যুত্তরে বলেন, মামলাটা ভাই আপনি চালান তো! প্রথা বলেন, ‘মামলা চালান মানে? সরকার কি আপনাকে বেতন দিচ্ছে না? এসব মামলায় সরকারের কি কোনো রেসপন্সিবিলিটি নাই? আমাকে মামলা চালাইতে বলছেন মানে? আপনি কী ধরনের কথা বললেন এটা?

তখন ওই এসআই বলেন, একটা মামলা চালাইতে গেলে অনেক কিছু লাগে আপা। আপনি আসেন, কথা বলতেছি।

‘অনেক কিছু কী লাগে? এই মামলা চালাতে থানা পুলিশ কিসের জন্য? রাতে যে ওর কাছ থেকে চারটা হাজার টাকা নিছেন, ওর মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে। আপনি উল্টো তার থেকে টাকা নিলেন। আরও তিন হাজার টাকা নিয়ে যেতে বলছেন। আর আমাকে বলতেছেন মামলাটা আপনি চালান?’

তিনি আরও বলেন, চাকরিটা কিসের করতেছেন? সরকার কি আপনাকে আরাম করার জন্য বেতন দেয়? জনগণের টাকায় তো সরকার বেতন দিচ্ছে।

তখন এসআই বলেন, ‘এখানে যে কী পরিমাণ খরচ হয়, সেটা কীভাবে ম্যানেজ করব আপা? অনেক খরচ হয় আপা, অনেক খরচ হয়।’

সোমবার (৮ জুলাই) এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মানবাধিকার নেত্রী আনোয়ার-ই-তাসলিমা প্রথা বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর আমি ওই এসআইকে অনেকবার ফোন দিছি। কথা বলছি। নিজে থানায় গিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে বাদী মোজাম্মেলকে দিয়েছি। পুলিশের এটা কাজ নয়। পেশাদার কোনো পুলিশ সদস্য এমনটা করতে পারেন না। আমি এটাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করে সোচ্চার হয়েছিলাম।’

ওই মামলার নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা রায়হান উজ্জামান বলেন, মামলার তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আসামি জেলে আছে। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যেই চার্জশিট দাখিল করা হবে।

কাফরুল থানার ওসি সেলিমুজ্জামান বলেন, ওই ঘটনায় প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে এসআই কুদ্দুসকে ক্লোজড করে ডিসির কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন যা কিছু সব ডিসি মহোদয় বলতে পারবেন।

এ ব্যাপারে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি মো. মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ওই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসআই আব্দুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) খাইরুল আমিন বলেন, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। একটি রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। সেটিও শুনেছি। তদন্ত শেষ হলে তারপর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সম্ভব হবে।

তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী চার-পাঁচদিনের মধ্যে তদন্ত শেষ হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে (এসআই কুদ্দুস) এখন পর্যন্ত অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। সাক্ষ্যপ্রমাণে তার আচরণগত সমস্যা রয়েছে। তার আচরণ পেশাদার ছিল না। তিনি ভুল করেছেন।

‘তার এ ধরনের ভুল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার বিরুদ্ধে আমরা আইনগতভাবেই শাস্তির সুপারিশ করব’- যোগ করেন তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ০৯,২০১৯)