দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : পরিকল্পনায়ই ছিল ভুল। ফলে বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করে দীর্ঘ ৯ বছরে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের কাজ হয়েছে সামান্যই।

নদী খনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাকে দুষণমূক্ত করা, বুড়িগঙ্গা-তুরাগ রুটে সারা বছর নৌ-চলাচলের উপযোগী করাসহ সেচ ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য নেয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে প্রকল্পটি নেয়ার পর তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ডিজাইন বদলাতে হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তবে ৩ বছরের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগতে পারে ১১ বছর।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিদ্যমান বাস্তবতায় ভৌত কাজের অগ্রগতি বাড়াতে যত দ্রুত সম্ভব জমি অধিগ্রহণ করা, সংশোধিত ডিজাইন অনুযায়ী বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং নিবিড় তত্ত্বাবধানের তাগিদ দিয়েছে। সেই সঙ্গে কাজ আলাদা করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে এটি সমাপ্ত করারও সুপারিশ করেছে।

গত জুন মাসে চলমান এ প্রকল্পের নিবিড় পরীক্ষণ করে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এই বিভাগের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

প্রকল্প নিয়ে কথা হয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা) মন্টু কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। বুধবার তিনি বলেন, প্রকল্প তৈরির সময় কিছুটা ভুল তো ছিলই। যেমন নদীর ওপর যেসব ব্রিজ রয়েছে সেগুলোর ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়টি মাথায়ই ছিল না। তবে ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জটিলতা দূর করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের এপ্রিলে নেয়া প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দু’দফায় ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সময় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপির তুলনায় ৬ বছর ৬ মাস বা ১৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ সময় বেশি লাগছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলছেন। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে প্রকল্প পরিকল্পনায় ভুলের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে পুরনো গাণিতিক মডেল সমীক্ষা এবং সময়োচিত বেজ লাইন সমীক্ষা ছাড়াই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া ভৌত মডেল সমীক্ষাটি শুধু প্রধান উৎসমুখ থেকে পুংলী নদীর ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় টঙ্গী খাল ও বুড়িগঙ্গার অফটেক পানি প্রবাহের যথার্থতা যাচাই করা হয়নি। এসব কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার সময় নদীর উৎসমুখে যেখানে যমুনা নদী থেকে মূল পানিপ্রবাহ আসে, সেখানে একাধিক নতুন বালুচর দেখা দেয়। তাছাড়া ধলেশ্বরী-পুংলী নদী ড্রেজিং ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণমূলক ড্রেজিং কাজের পরের বছর বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশ পলি দিয়ে ভরে যায়।

এভাবে বর্ষা মৌসুমে পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া ছিল নতুন চ্যালেঞ্জ। যেটি প্রকল্প তৈরির সময় বিবেচিত হয়নি। আবার বাংলাদেশ রেলওয়ে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তৈরি করা ২২টি সেতু সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কারণ নদী ড্রেজিংয়ের সময় যে পরিমাণ গভীরে খনন করা হবে ওই সব সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর ততটুকু গভীরে নাও থাকতে পারে। এ বিষয়টিও প্রকল্প তৈরির সময় ভাবা হয়নি। এরকম নানা বাস্তবতায় প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয়।

২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের কারিগরি সভায় মারাত্মক সব ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে- প্রকল্প গ্রহণের ৭ বছর আগে পরিচালিত দুর্বল গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে নিউ ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখে অফটেক স্ট্রাকচার ও ফিস পাস রেগুলেটর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।

এছাড়া ব্যাপক বেজলাইন ও ভৌত মডেল সমীক্ষা ছাড়াই ত্রুটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রকল্প তৈরি করায় এটি বাস্তবায়িত হয়নি। সূত্র জানায়, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ছিল ভূমি অধিগ্রহণ, গাইড বাঁধ নির্মাণ, কায়িক পরিশ্রম ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদী খনন, সেডিমেন্ট বেসিন নির্মাণ ও সংরক্ষণ কাজ, ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা।

প্রতিবেদনে আইএমডির পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া। এছাড়া বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত ও নাব্য সংকট দূর করতে প্রকল্পের প্রস্তাবিত প্রধান উৎসমুখের অবস্থান পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে মূল ধলেশ্বরী নদী পুনরুদ্ধার করে পুংলী নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পানির যথেষ্ট প্রবাহ বৃদ্ধি করা। দূষণ রোধে শিল্প ও পয়োবর্জ্য নিয়ন্ত্রণে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ।

বর্ধিত গাইড বাঁধ, তীর বাঁধ, ড্রেনেজ স্ট্রাকচার, বোট ল্যান্ডিং প্লাটফর্ম ইত্যাদি অবকাঠামো পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ভিত্তিতে যথাযথ নিরূপণ করে সংশোধিত ডিপিপি তৈরি করা। ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট, নদী খনন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বর্ধিত গাইড বাঁধ নির্মাণের কাজ এ প্রকল্পের সঙ্গে না রেখে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
অফটেক উৎসমুখ নির্ধারণ, সেডিমেন্ট বেসিন ও আউটলেট চ্যানেল থেকে পলি অপসারণ এবং ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কিত জটিল বিষয়গুলো সুরাহা করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আরও অনেক সময় প্রয়োজন। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার মাধ্যমে অন্য একটি প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ১১,২০১৯)