খালেদ মুহিউদ্দীন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে চেনেন? সম্প্রতি তিনি ‘মারাত্মক গর্হিত’ কাজ করেছেন৷ শীর্ষ আমলাদের একজন বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷

কী করেছেন অধ্যাপক ফারুক৷ গবেষণা করে কোন পাকা ধানে তিনি মই দিয়েছেন?

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক পাস্তুরিত দুধ নিয়ে গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ বাজার থেকে মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট এবং ইগলু ম্যাংগোর পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে বলেছেন, সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সসিন, অ্যান্টিবায়োটিক সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং অ্যান্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷

মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন বলেন, জার্নালে প্রকাশ হওয়ার আগেই ওই গবেষক তার তথ্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন৷ কিন্তু তাঁর গবেষণার স্যাম্পল সঠিক ছিল না৷ গবেষণাতেও ত্রুটি ছিল৷ তাঁকে সাতদিনের সময় দেয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে সন্তোষজনক কোনো জবাব না পেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে৷

হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন দুধ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা যাবে না৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন, ওই গবেষণার দায় ফার্মেসি বিভাগের নয়৷

পাঠক কেমন বুঝছেন?

কবি ও কথাসাহিত্যিক ব্রাত্য রাইসু তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘‘হা হা, দুধ নিয়া কেলেঙ্কারিরে এইবার রাষ্ট্র করতে চাইতেছে মন্ত্র৷ এর পরে দেশবাসীর আর জানার বাকি থাকবে না দুধে কী সন্দেহ!

এই ভাবেই ঠাকুর ঘরে কলা নিজেই নিজেরে ছোলকা সুদ্ধা ভক্ষণ করিয়া থাকে৷ খুব ভালো৷’’

দেখা যাক অধ্যাপক ফারুক কী বলেন৷ তিনি পালটা গবেষণায় ত্রুটি ধরানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷

১০ জুলাই দৈনিক খোলাকাগজকে তিনি বলেছেন, ‘‘একটি গবেষণার ত্রুটি বের করতে হয় আরেকটি গবেষণা দিয়ে-এটা হচ্ছে নিয়ম৷ মন্ত্রণালয় এ ধরনের পরীক্ষা করেছে কিনা আমি জানি না৷ তারা যদি পরীক্ষা করে থাকেন তাহলে আমাদের ত্রুটিগুলো দেখাক৷ ত্রুটি থাকলে আমরা নিশ্চয়ই তা শুধরে নেব৷ কিন্তু যদ্দুর জানি, আমাদের কাজে এখনো কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি৷’’

অধ্যাপক ফারুক সব দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পান, অথচ বিএসটিআই কেন পায় না? তিনি কী তবে দেশি দুধশিল্পের ধ্বংস চান? খোলাকাগজের সাংবাদিক তুষার রায়কে তিনি বলেন, ‘‘বিএসটিআই দুধের নয়টা নমুনা টেস্ট করেছে৷ তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী আদর্শ দুধ হতে গেলে ওই নয়টা প্যারামিটার থাকতে হবে৷ কিন্তু আমরা মনে করছি, সঠিক ফলের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট এগুলোও পরীক্ষা করা দরকার৷ এটা শুধু আমাদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে তা নয়৷ আইপিএস, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরীক্ষাতেও এসবের নমুনা মিলেছে৷ তাহলে সব আক্রমণ আমাকে করা হচ্ছে কেন? ওদের কি ধরতে পারে না, যারা এসব পরীক্ষার ফলাফল আমার আগেই প্রকাশ করেছে৷ তারাও তো অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছে৷ এই বিষয়টা কেন জানি সামনে আসছে না৷ আমি সরকার না, এজন্য? আমি দুর্বল, তাই?

প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা যদি অ্যান্টিবায়োটিক পেয়ে থাকি তাহলে এটার পরীক্ষা আবার করলেই তো হয়৷ আমরা তো পরীক্ষাগুলোর ব্যাপারে ওপেন৷ আমরা স্বচ্ছভাবে তালিকাও দিয়ে দিয়েছি৷ পরীক্ষা পদ্ধতিও দিয়ে এসেছি বিএসটিআইকে৷ তারা পরীক্ষাগুলো দেখুক না একবার৷ এখন বিএসটিআই যদি অ্যান্টিবায়োটিকের পরীক্ষা না করেই বলে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক নেই, তাহলে আমাদের আর কী করার আছে!’’

আর দেশি দুধের বাজার প্রসার আর টাকাওয়ালাদের ষড়যন্ত্র নিয়ে অধ্যাপক ফারুক বলেন, ‘‘আমরা যখন প্রেস কনফারেন্স করলাম, রিপোর্ট যখন প্রকাশ হচ্ছে তখন তথ্যটা যাচাই না করে বিভিন্ন জায়গায় নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে৷ তারপর দেশের একটি বড় গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়ায়ও নানা নিউজ করা হয়েছে৷ এখন এভাবে যদি নানাভাবে ছলচাতুরী করে তাহলে তো জনগণের আস্থা আরও কমে যাবে৷ আরেকটা কথা হলো, মানুষ তো আর আগের মতো নেই৷ তারা যাচাই করতে পছন্দ করেন৷ ফলে আমার আশঙ্কা এটা (তরল দুধ) এক সময় আবার বিদেশি দুধের বাজারে বাজারে পরিণত না হয়৷ মানে দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থা চলে গেলে তারা বিদেশি পণ্যের প্রতি ঝুঁকতে পারেন৷ আমরা তো সেটা চাই না৷ আমরা চাই, আমাদের দেশি ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা লাভ করুক৷’’

পাঠক আসুন অধ্যাপক ফারুকের পাশে দাঁড়াই৷ হুমকি ধমকি তো তিনি পাচ্ছেনই, শুধু গবেষণা করার কারণে যেন তাঁকে হেনস্থা না হতে হয়৷


লেখক: প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগ

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ১৩,২০১৯)