দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ কি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে! বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে, ডেঙ্গু কি মহামারি রূপ নেবে, কতদিন পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকবে- এমন অনেক প্রশ্ন নগরবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় চলতি বছরের সর্বোচ্চ একদিনে চার শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির নতুন রেকর্ড হয়েছে।

একসময় বলা হতো সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে তারা সঙ্গত কারণেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। কিন্তু এ বছর চিত্র ভিন্ন। ডেঙ্গুতে শুধু সাধারণ মানুষই আক্রান্ত কিংবা মারা যাচ্ছেন এমনটা নয়, এ বছর চিকিৎসকরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মারা যাচ্ছেন।

সর্বশেষ রোববার রাতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হলে হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেন হাজরাকে (৫৩) মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এর আগে গত ৩ জুন রাজধানীর উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসক নিগার নাহিদ দিপু রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মাস দেড়েকের ব্যবধানে দুজন চিকিৎসকের মৃত্যুতে এখন অনেক চিকিৎসকও ডেঙ্গুতে মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারাও চিন্তিত। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র পাঁচজন বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে কমপক্ষে ২২-২৫ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা ডেঙ্গু রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিদিন টেলিফোন ও মোবাইলে যোগাযোগ করে কীভাবে এ অবস্থার উন্নতি করা যায় সে ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, জুলাই মাসের গত ২১ দিনে শুধু হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫০। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ১৭৯। তাদের কাছে অফিসিয়ালি এখন পর্যন্ত পাঁচজন রোগীর মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে।

হালনাগাদ তথ্যানুসারে, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৬৫।

একাধিক ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের (স্ট্রেইন বা সেরো টাইপ)। এগুলো হলো- ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪।

তিনি বলেন, ২০০২ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডেন-১ ও ডেন-২ স্ট্রেইন দেখা যেত। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত ডেন-৩ তে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের অনেকেই দ্বিতীয় বারের মতো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এ পরিস্থিতিকে কী বলা যেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, অন্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এ বছর অনেক বেশি সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকোপ বেশি- এটাই বলা যাবে। তবে এ মুহূর্তে বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এ বছর বেশি হলেও দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে হিসাব করলে তা খুব বেশি নয়।

ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এ সময় ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকায় জ্বর হলেই তা ডেঙ্গু কিনা তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। জ্বর হলে ঘরে বসে না থেকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অধ্যাপক ফ্লোরার কাছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে গরমিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার পরই সরকারিভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অন্য যেগুলো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় সেগুলোর তথ্য আইইডিসিআরে আসে। ডেথ রিভিউ কমিটি সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হলে তবেই তা প্রকাশ করা হয়।

ডেঙ্গুর এ অবস্থা কতদিন অব্যাহত থাকবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্টোবর পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে।

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাপসাতালে ভর্তি ৪০৩ রোগীর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ৮৩, মিটফোর্ডে ৩৮, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩৩, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ৪৫, বারডেমে ৮, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ১৫, মুগদা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, বিজিবি হাসপাতালে ৫ ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৯ জন ভর্তি হয়েছেন।

বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ১২৩ জনের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেলে ২১, ইবনে সিনায় ১১, স্কয়ারে ৭, সেন্ট্রালে ১৭, গ্রিন লাইফে ৮, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল কাকরাইলে ১১, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৮, খিদমা হাসপাতালে ৪, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯, সালাউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ ও পপুলার হাসপাতালে ১৪ জন ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া খুলনা বিভাগে দুজন ভর্তি হয়েছেন।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ২২,২০১৯)