দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ যে টাকা নেন তার থেকে প্রায় দশগুণ বেশি টাকা নেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকরা। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক-বাবদ তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর চেয়েও বেশি টাকা নিচ্ছেন।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো থেকে পরিচালকদের সম্মানী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিকের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংক পরিচালকদের সম্মানী বাবদ খরচ করেছে দুই থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে। সেখানে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক পরিচালকদের সম্মানী-বাবদ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা।

পরিচালকদের সম্মানী-বাবদ এমন বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করা ‘অনৈতিক’ বলছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তার বেশির ভাগের সঙ্গে পরিচালকরা যুক্ত। পরিচালকদের অনৈতিক সুবিধার কারণে ব্যাংক খাতে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। সম্মানী-বাবদ একটি ব্যাংক থেকে তিন মাসে পরিচালকদের ৫০ লাখ টাকার ওপরে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ, এ তিন মাসে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ নিয়েছেন ৫১ লাখ ৭৭ হাজার ২৭৭ টাকা। গত বছরের (২০১৮) জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকটি থেকে পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ নেন ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৭ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলায় চলতি বছরের তিন মাসে ব্যাংকটি থেকে পরিচালকরা বেশি নিয়েছেন ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৩০ টাকা।

পরিচালকদের পাশাপাশি ব্যাংকটি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক-বাবদ ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে তিনি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের খরচ হয়েছিল ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ পরিচালকদের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনেও চলতি বছরে ব্যাংকটির অর্থ খরচের পরিমাণ মোটা অঙ্কে বেড়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, তিন মাসে একটি ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ৫১ লাখ টাকার ওপর সম্মানী নেয়া কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। পরিচালকদের এভাবে টাকা নেয়া অনৈতিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব আছে। এমডিদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যেমন খুশি পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের খরচের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রফিট (মুনাফা) কম হচ্ছে। মুনাফা কম হওয়ার কারণে আমানতকারীদের ইন্টারেস্ট কম দেয়া হচ্ছে এবং শেয়ারহোল্ডাররা কম লভ্যাংশ পাচ্ছেন।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ ১৫টির পরিচালকদের সম্মানী নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিপরীতে সমান সংখ্যক ব্যাংকের পরিচালকদের সম্মানী নেয়ার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় কমেছে।

ব্যাংক থেকে পরিচালকদের সম্মানী নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। চলতি বছরের তিন মাসে এ ব্যাংকের পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ নিয়েছেন ২১ লাখ ৯৪ হাজার ৫২ টাকা। গত বছরের প্রথম তিন মাসে এর পরিমাণ ছিল আট লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৭ টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরে ব্যাংকটির পরিচালকদের সম্মানী-বাবদ খরচ হয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ।

ব্যাংকটিরও পরিচালকদের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক-বাবদ খরচ বেড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ ব্যাংকটির খরচ হয় ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বেড়ে হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য ব্যাংকটির খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

পরিচালকদের সম্মানী নেয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এনসিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালকরা চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে সম্মানী-বাবদ নিয়েছেন ১৬ লাখ ৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। গত বছরের প্রথম তিন মাসে পরিচালকদের সম্মানী-বাবদ ব্যাংকটির খরচ হয় ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৯৪ টাকা।

ব্যাংক থকে সম্মানী-বাবদ সবচেয়ে কম টাকা নিচ্ছেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পরিচালকরা। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকটির পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ নিয়েছেন ৩৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকটির পরিচালকরা সম্মানী-বাবদ নেন ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ কম টাকা নেয়ার পাশাপাশি চলতি বছর ব্যাংকটির পরিচালকদের খরচও কমেছে।

ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ব্যাংকের দুরবস্থার কারণে এখন পুঁজিবাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে শেয়ারহোল্ডাররা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ পাচ্ছেন না। অথচ পরিচালকরা ঠিকই বিভিন্নভাবে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংক থেকে পরিচালকদের টাকা নেয়ার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা।

পরিচালকদের সম্মানী-বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা খরচের বিষয়ে মন্তব্য জানতে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।

সম্মানী-বাবদ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের টাকা নেয়ার চিত্র-

ব্যাংকের নাম

সম্মানী-বাবদ পরিচালকদের নেয়া টাকা

২০১৯ (জানুয়ারি-মার্চ)

২০১৮ (জানুয়ারি-মার্চ)

সিটি ব্যাংক

১১,৩৭,৫৩৬

৪,৪৮,০০০

এবি ব্যাংক

৭,১৩,১১২

১৪,২৮,২৮৯

আইএফআইসি ব্যাংক

৪,৩৮,০০০

৩,২২,৫০০

ন্যাশনাল ব্যাংক

১০,৯১,২৫১

১২,৫৪,৯৩০

পূবালী ব্যাংক

৫,৮৩,১১০

১৬,৬৯,৭৩৭

রূপালী ব্যাংক

১২,৩২,৮০০

৪১,৭৯,৪৪৩

ইউসিবি

৯,৬৪,৩২২

১৩,৩৯,৭০৩

উত্তরা ব্যাংক

৪,৪৮,০০০

৭,২০,০০০

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক

২,৮৩,০৮০

১,৩৮,৮৯৭

ইস্টার্ন ব্যাংক

১২,০১,৫৮৩

৯,৩৯,৭১৪

প্রাইম ব্যাংক

১০,৪৯,০৮৯

১০,০২,৩৭৯

সাইথইস্ট ব্যাংক

৫,৪২,৭৫৩

৬,১৫,১৯০

ঢাকা ব্যাংক

১১,৭০,৯৩৫

১১,০৩,৪৭০

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক

১১,৩১,৫৫২

১২,৮৭,৯১০

মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

৬,৯১,১০০

৭,৫৪,৫০০

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক

১৪,৯৪,২৪৩

২০,৩৫,৬২৮

ওয়ান ব্যাংক

১,৯৫,৭৫০

২,৫২,৭৫০

ব্যাংক এশিয়া

৩,৫৮,০০০

১০,৮৭,২০০

মার্কেন্টাইল ব্যাংক

১২,৪৮,৮০০

১২,৪৬,৪০০

এক্সিম ব্যাংক

৪,৬৮,০০০

৩,৬৫,০০০

যমুনা ব্যাংক

১৫,৫৪,১৪২

১৫,০৮,৭১৯

ব্র্যাক ব্যাংক

৮,৫০,৪০৭

৭,০৩,৫২৪

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক

১১,২৩,৭২৫

১৪,১৫,৫২১

প্রিমিয়ার ব্যাংক

২,৭২,০০০

২,৫৩,০০০

ট্রাস্ট ব্যাংক

৬,২৩,০০০

৭,১০,০০০

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

৪,৯৫,৬০০

১,৯৮,৬০০

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ১৮, ২০১৯)