দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলা মামলার ১৬ আসামি এখনও অধরা। পলাতক আসামিদের গ্রেফতার এবং বিদেশে থাকা আসামিদের দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সে কার্যক্রম চলছে কচ্ছপগতিতে।

কবে নাগাদ পলাতক আসামিদের গ্রেফতার বা বিদেশে থাকা আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে- তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছেন না। তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক আসামিদের লোকেশন আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে।

এক্ষেত্রে কিছু আইনি জটিলতাও রয়েছে। এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। শিগগিরই আমরা এর সুফল দেখতে পাব।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। তদন্তে উঠে আসে, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশসহ (হুজি) তিনটি জঙ্গি সংগঠন ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ও বর্বরোচিত ওই হামলার ঘটনা ঘটে।

এতে দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েকশ’ নেতাকর্মী। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

এদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের পৃথক দুটি মামলায় বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণা হলেও চূড়ান্ত বিচার এখনও শেষ হয়নি।

এ বছরের ১৩ জানুয়ারি দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

বর্তমানে এটি কার্য তালিকায় আসার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে এসব নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়।

ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর ১ মাস ২০ দিন পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলা দুটির রায় ঘোষণা হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে স্থাপিত আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন।

হত্যা মামলায় ১৪টি এবং বিস্ফোরক আইনের মামলায় ১২টি বিষয় বিবেচনা করা হয়। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামির মধ্যে দুজন এবং যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১৯ জনের মধ্যে ১২ জন পলাতক। এছাড়া রায়ে আনসার ও ভিডিপির সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরীসহ ১১ জন সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্তদের ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডও দেয়া হয়।

রায়ে ৪৯ আসামির সবারই সাজা হয়। যদিও মামলার আসামি ছিল ৫২ জন। এর মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও শরিফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামি ৪৯ জন।

রায় ঘোষণার সময় মোট ১৮ আসামি পলাতক থাকলেও রায় ঘোষণার পর গত ২৮ জানুয়ারি দুই পলাতক আসামি সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও সাবেক পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান খান বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওইদিনই তাদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

গ্রেনেড হামলা মামলা ও বিচার : গ্রেনেড হামলার ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়। ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিল থানায় এসআই ফারুক আহমেদ, শেখ হাসিনার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা করেন।

ওই বছরের ২০ অক্টোবর একই থানায় আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাদী হয়ে অপর মামলাটি করেন। মামলাগুলো একত্রে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগের ওপর। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়ায় মামলার কার্যক্রম থেমে যায়।

পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল করিম।

এতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর একত্রে চার মামলায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পৃথক দুটি চার্জশিট গঠন করেন আদালত। ১৭ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

২০০৯ সালের ৯ জুন ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ জুন অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত ওই বছরের ৩ আগস্ট অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।

২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় দফায় চার্জ গঠন করেন আদালত। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে জজ মিয়া নাটকের অবসান হয়। ২০১৭ সালের ৩০ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওই বছরের ১২ জুন আত্মপক্ষ সমর্থন ও ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়।

হামলায় যারা নিহত : আইভি রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগমসহ ২৪ জন নিহত হন।

হামলায় আহত : বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেনসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মী আহত হন।

পলাতক আসামিদের অবস্থান : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন।

বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ ব্যাংককে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন যুক্তরাষ্ট্রে, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছেন।

আর জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার পাকিস্তানে রয়েছেন। এছাড়া গ্রেনেড হামলায় সরাসরি জড়িত আসামি ফরিদপুরের আনিসুর মুরসালিন ও তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন দীর্ঘদিন ভারতের তিহার কারাগারে আছেন।

আসামিদের সাজা যেসব কারণে : আসামি আহসানউল্লাহ কাজলের মেরুল বাড্ডার ফ্ল্যাটে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার জন্য আসামিরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য পরিদর্শক রুহুল আমিনের বাড্ডার আনন্দনগরের বাড়ি মুফতি হান্নান ভাড়া নিয়ে জঙ্গিকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সরকারি বাসভবনে ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আবদুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নান, আহসানউল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের ও মাওলানা তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।

২০ আগস্ট আহসানউল্লাহ কাজল ও মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দল আবদুস সালাম পিন্টুর ধানমণ্ডির বাসা থেকে মাওলানা তাজউদ্দিনের সরবরাহ করা ১৫টি আর্জেস গ্রেনেড ও নগদ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন।

গুলশান থানাধীন লালাসরাই মৌজায় অবস্থিত বনানী মডেল টাউনের ডি ব্লকের ১৩ নম্বর রোডের ৫৩ নম্বর বাড়ি যা হাওয়া ভবনে তারেক রহমান অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্রমূলক সভা করেন এবং জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিটিং করেন।

তারেক রহমান জঙ্গি নেতাদের হামলার নির্দেশ ও প্রশাসনিক সহায়তার আশ্বাস দেন। আর এসব কারণে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ২০, ২০১৯)