দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। স্বদেশ, নগর আর মানুষের সঙ্গে গভীর প্রেম ও আত্মিকতায় বাঁধা ছিল তার কবিতা। তিনি নাগরিক কবি শামসুর রাহমান। আজ এই মহান মানুষটির ৯১ তম জন্মদিন আজ। জন্মদনে বিশেষভাবে স্মরণ করছি তাকে।

শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে জন্ম নেন। তার বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী, মা আমেনা বেগম। ৪০০ বছরের পুরনো নগর ঢাকাতেই বেড়ে ওঠেন তিনি, এখানেই কেটেছে তার সারাজীবন। শৈশবেই কবিতায় হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৫৭ সালে ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজের সহসম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন শামসুর রাহমান। স্বাধীন বাংলাদেশে পুরো এক দশক তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

সেই ছেলেবেলা থেকে এই কবিকে আমরা চিনে নিয়েছিলাম তার অসংখ্য কবিতায়।

এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
এই কবিতা পড়ে আমরা হেসে একেবারে কুটি কুটি হতাম।
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
নিজের ভেতরেই কেমন যেন উন্মাদনা আসতো, স্বাধীনতাকে বুকের মধ্যে ধারণ করতে আরও প্রেরণা পেতাম।
‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।’
এই কবিতায় স্বয়ং আসাদকে যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম সত্যি সত্যি।
‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’

এমন শক্ত লেখনীর দেখা সবসময় মেলে না। শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয়বস্তু প্রেম, মানবিকতা, স্বাধীনতা ও মানুষের বিকাশের পক্ষে; প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মান্ধতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে নিজের কলম ও কাব্যশক্তি নিয়ে যুক্ত ছিলেন তিনি। এমনকি কখনো কখনো রাজপথেও নেমেছেন লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে। আসাদের আত্মদানের পর যেমন, তেমনি নূর হোসেনের মৃত্যুর পরও তার কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ধারালো কবিতা। তার কবিতা ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক একই সঙ্গে গীতিময় ও মহাকাব্যিক। বাংলা কবিতায় আধুনিকতা, ব্যক্তির নিঃসঙ্গ, বিবমিশা ও আনন্দলহরীর অনিন্দ্য এক রূপকার শামসুর রাহমান।

শামসুর রাহমান একাধারে কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, কলামিস্ট, অনুবাদক ও গীতিকার। পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে একাধারে প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় তিনি বিরতিহীনভাবে সাহিত্য-সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে কাজ করেন। তাকে বাংলা সাহিত্যে ‘স্বাধীনতার কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

কবিতায় তিনি স্বাধীনতার মানসে ব্যাপক কাজ করেন। মৌলবাদ, ধর্মান্ধতাবিরোধী বিষয়েও স্বাক্ষর রাখেন তিনি। তার মধ্যে ছিল প্রেম, দ্রোহ ও বিশ্বজনীনতা, যা আজও সব বয়সের মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কবির অসংখ্য কবিতা সর্বস্তরের মানুষকে উৎসাহিত করে আসছে। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন।

ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে আঠার বছর বয়সে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করার পর কবি ১৯৫৭ সালে ডেইলি মর্নিং সান পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কর্ম ও পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরে পাকিস্তান রেডিও’তে দেড় বছর চাকরি করেন। দেশ স্বাধীনের পর ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় যোগ দেন। এক পর্যায়ে এই পত্রিকার প্রধান সম্পাদকসহ ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে ‘মূলধারা’, ‘অধুনা’ নামে দু’টি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশ পায় ১৯৬০ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রুদ্র করোটি’তে (১৯৬৩ ) এবং পরবর্তীতে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ (১৯৬৭), ‘নিরালোকে দিব্যরত’ (১৯৬৮), ‘নিজ বাসভূমে’ ( ১৯৭০), ‘বন্দি শিবির থেকে’সহ (১৯৭২) তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৪৮টি, ১০টি কাব্য সমগ্র, চারটি উপন্যাস, দুইটি গল্প সমগ্র, দুইটি কলাম, পাঁচটি অনুবাদ কবিতা, দুইটি অনুবাদ নাটক, একটি জীবনী, ১০টি শিশুতোষ গ্রন্থসহ মোট ৯৮টি বই প্রকাশ পায়। আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাদীনতা দিবস পদক, ভারতের আনন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ছিল তার থলিতে। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট পরপারে পাড়ি জমান এই গুণী মানুষটি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/অক্টোবর ২৩,২০১৯)