দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: পুরো দেশ চিৎকার করে বলছে, আমরা সাকিব আল হাসানের পাশে আছি। দেশের সব মিডিয়াতেও এর প্রতিধ্বনি বেজে উঠছে। বাঙালি ক্রিকেটপাগল জাতি, বাঙালি আবেগি জাতি। সাকিবকে নিয়ে বাঙালির আবেগ কাজ করবেই। কিন্তু আবেগটাকে পাশে সরিয়ে আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি যে সাকিব কী করেছেন এবং কেন করেছেন? আবেগে ভর করে আমরা যদি বলি, লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেয়েছেন সাকিব, তাহলে বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সাকিব মোটেই লঘু পাপ করেননি। তার অপরাধ গুরুতরই বলা চলে। পুরো ঘটনাতেই সাকিবের পাঁচটা অসততা পাওয়া যাচ্ছে।

১. ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জুয়াড়ি দীপক আগাড়ওয়াল সাকিবের সাথে তিনবার যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু একবারও সাকিব এ বিষয়ে আইসিসি বা বিসিবিকে কাউকেই কিছু জানাননি। এর আগে আয়ারল্যান্ডে যখন জুয়াড়িরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তখন তো তিনি আইসিসিকে জানিয়েছিলেন। তাহলে দীপক আগাড়ওয়ালের ক্ষেত্রেও কেন তিনি সেটা করলেন না? সাকিব স্বীকার করেছেন যে তিনি ভুল করেছেন। কিন্তু এত বড় একটি বিষয় নিয়ে তার মত অভিজ্ঞ একজন খেলোয়াড় কীভাবে এই ভুল করলেন সেই ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তিন তিন-বার প্রস্তাব পেয়েও কেন সাকিব সেটা সবার কাছে গোপন করেছিলেন?

২. সাকিবকে আগাড়ওয়াল কয়েক দফায় ওয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছিল। এক পর্যায়ে সে বলেছিল মেসেজগুলো ডিলিট করে দিতে। আশ্চর্যজনকভাবে সাকিব ঠিক সেটাই করেছিলেন। একজন লোক তাকে প্রস্তাব দিল, তারপর বললো মেসেজ মুখে ফেলতে। আর সাকিবও বাধ্য ছেলের মতো সেটা শুনলেন। জুয়াড়ি এবং ফিক্সিং এর বিষয়ে সাকিব কি এতটাই অবুঝ? সাকিব যদি বুঝেই থাকেন এটার মধ্যে গলদ আছে তাহলে বিসিবি বা আইসিসিকে না জানিয়ে মেসেজ মুছে ফেলার কারণটা কী? এখানেই সাকিবের ‘ভুলের’ (নাকি পাপের) বহর শেষ হচ্ছে না। মেসেজ পেয়ে সাকিব আগাড়ওয়ালের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সাকিব যদি সৎই হয়ে থাকেন তাহলে কেন তিনি জুয়াড়ির সাথে দেখা করতে চাইলেন? এর মানে কী এমন যে, শেষ পর্যন্ত ফিক্সিং না করলেও ফিক্সিংয়ের মতলব ছিল সাকিবের? নাকি মাপতে চেয়েছিলেন কোন পথে থাকলে কত লাভ হবে?

৩. সাকিবকে দুইবার আইসিসি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। প্রথমবার এ বছরের জানুয়ারিতে। এরপর গত আগস্টে। সাকিবের মতো একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার, যিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আছেন, তার জন্য এটা না বোঝা অসম্ভব যে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু সাকিব দুবার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েও সবকিছু চেপে গেলেন। সতীর্থ বা দেশের ক্রিকেট বোর্ড কাউকেই তিনি কিছু বললেন না। কেন এত লুকোচুরি করেছেন তিনি?

৪. আগস্টে আকসুর জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব তার দোষ স্বীকার করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটা নিষেধাজ্ঞা আসছে। এরপর তিনি দুটো বড় বড় চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। এরমধ্যে একটি ছিল বিপিএলের টিম রংপুর রাইডার্সের সঙ্গে। অন্যটি মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীন ফোনের সঙ্গে। যারা দেশের ক্রিকেট এবং বিজ্ঞাপনী বাজার দুটোরই খোঁজ খবর রাখেন তাদের টাকার অংকটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দুটো চুক্তি করার সময়ই সাকিব জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগ এবং আইসিসির জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি বেমালুম চেপে গিয়েছেন। নিষিদ্ধ হওয়ার পর আয়ের অনেকগুলো পথ বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভেবেই কি তিনি তড়িঘড়ি করে চুক্তিগুলো করে টাকা নিয়েছিলেন?

যেকোনো চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো, সেখানে কোনো পক্ষই সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় গোপন করতে পারবে না। সাকিব সেটাই করেছেন। গ্রামীন ফোন খেলোয়াড় হিসেবে সাকিবের ভাবমূর্তি এবং সুনামের জন্যই তার সঙ্গে চুক্তি করেছিল। সেই ভাবমূর্তিটাই যে কয়েক দিনের মধ্যে খোয়া যাবে তার আভাস তো সাকিব পেয়েছিলেন। তিনি যদি সৎই হয়ে থাকেন, তাহলে কেন তিনি এটা গোপন করলেন?

রংপুর রাইডার্সের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আগামী বিপিএল এ সাকিব তাদের দলে খেলবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই সময়টাতেই নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে সেটা আন্দাজ করেও তিনি রংপুর রাইডার্সকে জানাননি। এটা কী অসততা নয়?

৫. পরপর দুবার আইসিসির জিজ্ঞাসাবাদ। সেখানে সবকিছু স্বীকার করে নেওয়া। এরপর ক্রিকেটারদের নিয়ে আন্দোলনে যাওয়া। নিষিদ্ধ হচ্ছেন বুঝতে পেরেই কি সাকিব এই আন্দোলনটা শুরু করেছিলেন? তাকে তো এর আগে কখনোই নিজেরটা ছাড়া বাকি ক্রিকেটারদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব হতে দেখা যায় নি। এমনকি সিনিয়র ক্রিকেটারদের দলের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা থাকে, সাকিবের ক্ষেত্রে সেটাও একেবারেই কম। জুনিয়রদের অনেকেই তাকে স্বার্থপরও বলেন। সেই সাকিবই এবার হঠাৎ করেই কেন দলের সব ক্রিকেটারদের দাবি দাওয়া আদায়ে আন্দোলনে নেমে পড়লেন? সেটাও আবার বিসিবিকে কিছু না জানিয়ে? খেলোয়াড় বা যেকোনো পেশার লোকই আন্দোলনে যেতে পারে। কিন্তু তার আগে তো তারা কর্তৃপক্ষকে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো জানায়। কর্তৃপক্ষ দাবিগুলো না মানলে তখন আন্দোলন শুরু করে সবাই। কিন্তু এবার ক্রিকেটাররা কেন সেই পথে না হেঁটে উল্টো পথ ধরলেন? সাকিবই কী তাদের উস্কে দিয়েছিলেন? তিনি কী এটাই চেয়েছিলেন যে বোর্ড তাকে নিষিদ্ধ করুক, তাহলে আইসিসির নিষেধাজ্ঞাটা চাপা পড়ে যাবে? নাকি সাকিব চেয়েছিলেন তিনি একা নন, সবাই বিতর্কিত হোক?

অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজসহ অনেক দেশই এরকম আন্দোলনের জন্য পুরো টিমকে বসিয়ে রেখে দ্বিতীয় একটি দল গড়ে খেলা চালিয়ে যায়। সাকিবও কী তেমনটাই চেয়েছিলেন যে, বিসিবি পুরো টিমকেই বসিয়ে দিয়ে জুনিয়রদের একটা দল ভারতে পাঠাক?

সাকিব দারুন বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং অসাধারণ দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ। একারণেই তাকে নিয়ে এই প্রশ্নগুলো উঠছে। তিনি ফিক্সিং করেননি বা টাকা নেননি এটা হয়তো সত্য। কিন্তু যে বিষয়গুলো লুকিয়েছেন এবং এরপর যা যা করেছেন সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তাকেই দিতে হবে। তার নিজের জন্য এবং দেশের ক্রিকেটের জন্য এটা খুব বেশি প্রয়োজন।

ব্যক্তিজীবন বা পেশাগত জীবন যেখানেই হোক না কেন, একজন মানুষ যদি সৎ না হন, তাহলে তার বিপদ আরও বাড়ে। কারণ সত্য বড় কঠিন জিনিস। তাকে লুকিয়ে রাখা যায় যায় না। এক দিন না একদিন সত্য বেরিয়ে আসবেই। সেটা হওয়ার আগেই সাকিবের উচিৎ হবে এই পাঁচটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া। ভবিষ্যতে যদি কোনো গবেষণা বা অনুসন্ধানের মাধ্যমে সাকিবের লুকিয়ে রাখা বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়ে যায় সেটা হবে তার জন্য আরও লজ্জার। কারণ ইতিহাস বড় নির্মম। যে ইতিহাস সাকিবকে আজ নায়কের মর্যাদা দিচ্ছে, সেই ইতিহাসই হয়তো একদিন তাকে ঘৃণার আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলবে।

সাকিব যে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় এটা নিয়ে কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেও সাকিব অসাধারন একজন খেলোয়াড়। কিন্তু তাই বলে তার ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমীর কাজ হতে পারে না। আমরা জানি যে, সাকিব ম্যাচ ফিক্সিং করেননি। কিন্তু তিনি যে ভুলগুলো করেছেন তা তো কম নয়। আমরা আবেগী জাতি। আমাদের আবেগের তোড়ে সত্যটা ভেসে যায়। কিংবা সত্যের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাই। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের স্বার্থেই আমাদের সত্যটা জানতে হবে। হয়তো সাকিবের কোনো দোষই নেই। কিন্তু পুরো ঘটনাটা ঘিরে যে প্রশ্নগুলো উঠছে তার উত্তর তাকেই দিতে হবে। নয়তো, কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় কোন ঝড় এসে হয়তো দেশের ক্রিকেটটাকেই ধ্বংস করে দেবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/নভেম্বর ০১,২০১৯)